ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শ্রীলঙ্কার পদক্ষেপ অনুকরণযোগ্য

মো. সহিদুল ইসলাম সুমন
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শ্রীলঙ্কার পদক্ষেপ অনুকরণযোগ্য

বিশ্বের অনেক দেশ গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের পর ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করেছে এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। শ্রীলঙ্কা সরকারও বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকটে এমন কিছু করার সুযোগ পেয়েছে, যা করার জন্য আগে কখনোই চেষ্টা করতেও হয়নি। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটে চরম জ্বালানি ও গ্যাসের ঘাটতি দেখা গেছে, মুদ্রার অবমূল্যায়ন প্রায় হাইপারইনফ্লেশন, ওষুধের ঘাটতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে দীর্ঘ বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে শ্রীলঙ্কাকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে এবং এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। কয়েক দশকের রাজস্ব ঘাটতি, চলতি হিসাবের ঘাটতি, একটি স্ফীত সরকারি খাত, কর রাজস্ব হ্রাস এবং ভর্তুকি মূল্য এই অবস্থার দিকে পরিচালিত করেছে। ১ বছর আগে অর্থনৈতিক সংকটে রীতিমতো অচল হয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা। প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়, জ্বালানিসংকট চরমে পৌঁছায়, পেট্রলপাম্পগুলোতে অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি শুধু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। জন-অসন্তোষ চরমে ওঠে। গণরোষের মুখে পড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এরপর দায়িত্ব নেন রানিল বিক্রমাসিংহে। রিজার্ভ সংকটে দেউলিয়া শ্রীলঙ্কার জন্য গত বছর আরো বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল মূল্যস্ফীতি। ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশে। বিপাকে পড়ে গৃহস্থালি থেকে শুরু করে শিল্পোৎপাদন পর্যন্ত, অর্থনীতির সব খাত-উপখাত। বছর শেষে অর্থনীতিতে সংকোচনের হার দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো জাদুবলে নয় বরং নীতিগত কিছু সিদ্ধান্তের ফলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ধ্বংসের কাছে চলে যাওয়া শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। দেশটির অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন পর্যটন খাতে সুদিন ফিরছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, শিল্প উৎপাদন বাড়ছে এবং কৃষি উৎপাদনও ভালো হচ্ছে। ফলে রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর পেছনে মূল কৃতিত্ব দেয়া হচ্ছে দ্বীপদেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পি নন্দলাল বীরাসিংহেকে। তার নেতৃত্বে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কার (সিবিএসএল) নেয়া পদক্ষেপগুলোই দেশটিকে কার্যকরভাবে সমৃদ্ধির পথে ফিরিয়ে এনেছে বলে মনে করা হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় গত জুলাইয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ও অর্থমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই দেউলিয়াত্ব থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ লক্ষ্য পূরণে তার সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গাও এখন নন্দলাল বীরাসিংহে। ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে এ বছরের জুলাইয়ের ৬ দশমিক ৩ শতাংশে এসে দাঁড়ায় মূল্যস্ফীতির হার। আগস্টে তা কমে ৪ শতাংশ হল। অর্থাৎ প্রায় এক বছরের মাথায় দেশটির মূল্যস্ফীতি ৬৯.৮ শতাংশ থেকে ৬.৩ শতাংশে নেমে এলো। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশাবাদ প্রকাশ করেছে, আরো বেশ কয়েক মাস মূল্যস্ফীতির এই নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থাকবে। সাধারণত অর্থনীতিবিদরা আগের বছর বা মাস অথবা কোনো নির্দিষ্ট সময়কালের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করে খাদ্য, কাপড়, পোশাক, বাড়ি, সেবা প্রভৃতি উপাদানের দাম বৃদ্ধির যে পার্থক্য যাচাই করেন, সেটাই মূল্যস্ফীতি। শ্রীলঙ্কার ব্রোকারেজ হাউস অ্যাকুইটি স্টক ব্রোকারের গবেষণা প্রধান শিহান কুরে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির হার প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুতগতিতে কমছে। অংশত-এর কারণ হচ্ছে শ্রীলঙ্কার রুপির দরবৃদ্ধি, যে কারণে আমদানি ব্যয় কমেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আশা করছি, মূল্যস্ফীতির হার এভাবে কমতে থাকবে এবং বছরের শেষ নাগাদ তা ৫ শতাংশের ঘরে নেমে আসবে।’

একটি বিবৃতিতে, সেন্ট্রাল ব্যাংক অফ শ্রীলঙ্কা (সিবিএসএল) উল্লেখ করেছে যে, ‘এই নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়াটি কঠোর আর্থিক এবং রাজস্ব নীতির পিছিয়ে যাওয়ার প্রভাব, সরবরাহের দিকের উন্নতি, শক্তি এবং খাদ্যের মূল্যস্ফীতি এবং অনুকূল মৌলিক বিষয়গুলোর দ্বারা সমর্থিত।’ গত ১ জুন শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদের হার ২৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়েছে, যা ২০২২ সালে দ্বীপরাষ্ট্রের অর্থনীতির ‘ঐতিহাসিক সংকোচনের’ পর এটি প্রথম, এটি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করবে এবং প্রবৃদ্ধির জন্য প্রেরণা দেবে। (যে সুদহারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়, সেটিই রেপো রেট বা নীতি সুদহার। অর্থনীতিতে নগদ তারল্যের জোগান দিতেই মুদ্রানীতির এ গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারটি ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।) শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল ব্যাংকের মনিটারি বোর্ড নীতি সুদের হার ২৫০ বেসিস পয়েন্ট কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই বলে যে মুদ্রাস্ফীতি প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত কমছে। ব্যাংকের পর্ষদ গত ৩১ মে একটি সভা করেছে। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্থায়ী আমানত সুবিধা হার (এসডিএফআর) এবং স্থায়ী ঋণ সুবিধার হার (এসএলএফআর) ২৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে যথাক্রমে ১৩.০০ শতাংশ এবং ১৪.০০ শতাংশ করেছে। সেন্ট্রাল ব্যাংক বলেছে, ‘মুদ্রাস্ফীতির প্রত্যাশিত গতির চেয়ে দ্রুত ধীরগতি, মুদ্রাস্ফীতির চাপের ক্রমান্বয়ে বিলীন হওয়া এবং মুদ্রাস্ফীতির প্রত্যাশাকে আরো নোঙর করার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আর্থিক অবস্থা সহজ করার লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে,’ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ‘এই ধরনের আর্থিক সহজীকরণের সূচনা আর্থিক বাজারে চাপ কমানোর সময় ২০২২ সালে প্রত্যক্ষ করা কার্যকলাপের ঐতিহাসিক সংকোচন থেকে অর্থনীতির জন্য একটি অনুপ্রেরণা প্রদান করবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী সময়ের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে, প্রত্যাশিত সময়ের আগে একক-অংকের স্তরে পৌঁছাবে।’ সরকারি পরিসংখ্যান অফিস ঘোষণা করেছে যে, মে মাসে মূল্যস্ফীতি ২৫.২ শতাংশ রেকর্ড করা হয়েছে, যা এপ্রিলের ৩৫.৩ শতাংশ থেকে কমেছে। জানুয়ারিতে রেকর্ড করা ৩৬০ থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুপি ২৯৫-এ নেমে এসেছে। মে মাসের শেষের দিকে অফিসিয়াল রিজার্ভ ৩ বিলিয়নের উপরে উন্নীত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, মার্চে আইএমএফ ২.৯০ বিলিয়ন ডলার বেলআউটের পর থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখেছে। অধিকন্তু, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা এবং ঋণ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। যাই হোক, দেশটি সম্প্রতি তার ভোক্তা মূল্যস্ফীতির হার এই বছরের জুনে ১২ শতাংশ থেকে জুলাই মাসে ৬.৩ শতাংশ-এ নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। সত্যিই একটি প্রশংসনীয় অর্জন। মনে হচ্ছে, শ্রীলঙ্কা তার আর্থিক সংকট থেকে ফিরে আসার পথে খুব ভালোভাবে এগিয়ে চলেছে, যা একসময় প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। শ্রীলঙ্কা ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ২০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। এমনকি অন্যান্য দেশ ও সংস্থার ঋণও এখন একটু একটু করে পরিশোধ করে দিচ্ছে শ্রীলঙ্কা। অধিকন্তু, ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আইএমএফ প্রায় ৩ বিলিয়ন বেলআউট (যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করেছিল) এবং কম আমদানি বিধিনিষেধ এবং বিদ্যুতের ঘাটতি উন্নত করতে গৃহীত পদক্ষেপগুলো মূল্যস্ফীতিকে অনেকাংশে কমাতে সাহায্য করেছে। সিবিএসএলে নন্দলাল বীরাসিংহে ও তার সহকর্মীরা এতদিন শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার ওপর জোর দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। সেটি নিয়ন্ত্রণে আসায় তারা এখন মনোযোগ দিচ্ছেন অর্থনীতিকে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরিয়ে আনার ওপর। গত বছর দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি বছর তা ২ শতাংশে নেমে আসার পূর্বাভাস রয়েছে। এ অবস্থায় প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে শিগগিরই সুদহার ২০০ বেসিস পয়েন্ট (২ শতাংশ) কমিয়ে আনার কথা ভাবছে সিবিএসএল। এর আগে জুন ও জুলাইয়ে সুদহার ৪৫০ বেসিস পয়েন্ট (সাড়ে ৪ শতাংশ) কমিয়েছিল দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও এর কিছুদিন আগেও মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আগ্রাসীভাবে বাড়ানো হয়েছে সুদহার। চলতি বছরের এপ্রিল ও মার্চে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছিল রেকর্ড ১ হাজার ৫০ বেসিস পয়েন্ট (সাড়ে ১০ শতাংশ)। মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার বিশেষজ্ঞ নন্দলাল বীরাসিংহে দায়িত্ব নিলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বেশ কিছুদিন নিজের ক্যারিশমা দেখানোর সুযোগ পাননি। কেননা আর্থিক দেউলিয়াত্ব, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের সংকট ক্ষুব্ধ লংকাবাসীকে রাস্তায় নামিয়েছিল। ভেঙে পড়েছিল রাষ্ট্র ও প্রশাসন। রাষ্ট্র ও সরকারের নির্বাহী প্রধানরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিলেন। এমন এক পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের মে মাসের মাঝামাঝি এক বক্তব্যে নন্দলাল বীরাসিংহে বলেন, ‘অনতিবিলম্বে সরকার গঠন না হলে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের আর কোনো আশাই থাকবে না।’ তার সে হুঁশিয়ারির মধ্যেই নতুন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন রনিল বিক্রমাসিংহে। এর পরও দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না ফেরায় পদত্যাগের হুমকি দেন ড. নন্দলাল বীরাসিংহে। গোতাবায়া রাজাপাকসে ক্ষমতা ছাড়ার পর দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরতে থাকে। নন্দলাল বীরাসিংহেও শ্রীলঙ্কার আর্থিক ও মুদ্রাবাজার খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হওয়ার সুযোগ পান। যদিও মূল্যস্ফীতি ততদিনে নিয়ন্ত্রণের প্রায় ঊর্ধ্বে, যা সেপ্টেম্বরে গিয়ে দাঁড়ায় রেকর্ড সর্বোচ্চে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আগ্রাসীভাবেই সুদহার বাড়াতে থাকে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগ্রাসী সুদহার নীতির সুফলও মিলতে থাকে। নিয়ন্ত্রণে আসে ঋণের প্রবাহ। আবার এ বর্ধিত সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় বাজারভিত্তিক পদ্ধতিকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা (বিশেষ করে ডলার) ক্রয়-বিক্রয়ের প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঠেকানো হয় রুপির বিনিময় হারে পতনকে। এক পর্যায়ে ডলারসহ অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে লংকান রুপির বিনিময় হার বাড়তে থাকে। এখন অর্থনৈতিক সংকটের ধাক্কা একটু একটু করে কাটিয়ে উঠছে দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। আর তার সুফল পেতে শুরু করেছে দেশটির জনগণ।

লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত