শরৎকালে প্রকৃতির নতুন রূপ

প্রকাশ ঘোষ বিধান

প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ঋতুর রানি শরৎকালে প্রকৃতি সেজেছে অপরূপে। কাশফুলের শুভ্রতা আর সাদা মেঘের ভেলা। চারদিক নতুন সবুজ আর ফুলের মেলা। নদী ধার আর উলোবনে উঠে উঁকি দেয় সাদা সাদা কাশফুল। আকাশের উজ্জ্বল নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে পাঁজা পাঁজা তুলার মতো মেঘ উড়ে যায়। শরৎকালের প্রকৃতিতে যেনো রূপের মেলা, রূপের যেন নেই কোনো তার শেষ। ঋতুর রানি শরৎকাল। বর্ষার ঘন বাদল বৃষ্টি শেষ হলে আগমন ঘটে শরতের। শ্রাবণ শেষে অবিরত বৃষ্টির বিরাম ঘটলেই প্রকৃতি নতুন রূপে সাজে। শিউলি তলায় হালকা শিশিরে ভেজা দুর্বাঘাসের ওপর চাদরের মতো বিছিয়ে থাকে সাদা আর জাফরন রং মেশানো শেফালী, টগর আর শিউলি ফুল। গাছে গাছে নানা রং-এর ফুল আর বিলে শাপলার সমারোহ। সকালে শিশিরভেজা ফসলের মাঠে পাকা ধানের ডোগায় সোনালি রোদ গলে গলে পড়ছে। ধানখেতের পাতায় শিশিরবিন্দু জানান দিচ্ছে শীত আসছে। গাছপালা বৃক্ষ হয়ে উঠেছে সতেজ ও সুন্দর। শরৎকালের প্রকৃতিতে এ যেনো এক অনন্য রূপ। আকাশের দীপ্তিমান নীল রঙের আভা। ঘন মেঘের নীলিমা স্পর্শ করে মালার মতো ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় নানা প্রজাতির পাখি। শরৎ নিয়ে আসে অন্যরকম এক মধুরতা। সূর্য্যরে নরম আলোয় সবুজ প্রকৃতি হয় নয়ন মনোমুগ্ধকর। গাছপালা হয়ে ওঠে সতেজ ও সুন্দর। মনে হয় চারদিকে সবুজের সমারোহ। ধানখেত হয়ে ওঠে চোখ ধাঁধানো সবুজ প্রান্তর। নদীর তীরে কাশবনে উঁকি দেয় সাদা সাদা কাশফুল। ভোরবেলা শিউলি তলায় হালকা শিশিরে ভেজা দুর্বাঘাসের ওপরে চাদরের মতো বিছানো থাকে সুমধুর ঘ্রাণ মেশানো রাশি রাশি শিউলি ফুল। শরতের আগমনে বাংলার প্রকৃতি দোয়েল, কোয়েল, ময়না, টিয়ার মধুর গুঞ্জনধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। ভাদ্র ও আশ্বিন দুই মাস মিলে শরৎকাল। বাংলার ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু। শরৎকে ইংরেজিতে অটাম বলা হলেও উত্তর আমেরিকায় একে ফল হিসেবে ডাকা হয়। পৃথিবীর ৪টি প্রধান ঋতুর একটি হচ্ছে শরৎকাল। উত্তর গোলার্ধে সেপ্টেম্বর মাসে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মার্চ মাসে শরৎকাল গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের মধ্যবর্তী ঋতু হিসেবে আগমন করে। এ সময় রাত তাড়াতাড়ি আসে এবং আবহাওয়া ঠান্ডা হতে থাকে। মেঠো পথের ভোরে হালকা কুয়াশা। সূর্যোদয়ের মুহূর্তে মৃদু হাওয়া। এরপর কাঠফাটা রোদ। কখনো আবার পরক্ষণেই ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিও এদিকে আছে, তো ওদিকে নেই। বাইরে গেলে কখনো স্বেদে সিক্ত, আবার কখনও বৃষ্টিস্নাত। এই তো শরতের রূপ। শরৎ বাংলার ঋতু পরিক্রমায় সবচেয়ে মোহনীয় ঋতু। শরতের জ্যোৎস্নার মোহিত রূপ নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যায় না।

শরৎকাল : যে ঋতুতে অনিন্দ্য সৌন্দর্যে ধরা দেয় প্রকৃতি শরতের রূপের তুলনা নেই। শিউলিঝরা সকাল, দুর্বাঘাসে শিশিরের ফোঁটা, নদী তীর বা বনের প্রান্তে কাশফুলের সাদা এলোকেশের দোলা, আকাশের নরম নীল ছুঁয়ে ভাসা শুভ্র মেঘের দল, নৌকার পালে বিলাসী হাওয়া বাংলার শরতে প্রকৃতির এমনই মন ভোলানো দান। এ সময় মেঘমুক্ত আকাশে শিমুল তুলোর মতো ভেসে চলে সাদা মেঘের খেয়া। ভেসে বেড়ানো মেঘের প্রান্ত ছুঁয়ে উড়ে চলা পাখপাখালির ঝাঁক, বাঁশবনে ডাহুকের ডাকাডাকি, বিলঝিলের ডুবো ডুবো জলে জড়িয়ে থাকা শালুক পাতা, আঁধারের বুক চিরে জোনাকির রুপালি সেলাই, ঘোর লাগা চাঁদের আলো, কী নেই এই ঋতুর কাছে। শরতের এক আনন্দময় ঘ্রাণ আছে। হয়তো এ জন্য বলা হয়ে থাকে, প্রকৃতিতে শরৎ আসে নববধূর মতো। গ্রীষ্মের দাবদাহ আর বর্ষাকালের অবিরাম বর্ষণের পর এই ঋতু জনজীবনে আসে ভিন্ন চেহারায়, স্বস্তি নিয়ে। প্রকৃতি হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ ও মনোরম। দিগন্তবিস্তৃত মাঠে মাঠে তখন কচি ধানের হেলেদুলে কাটানো কৈশোর। এমন সবুজের সমারোহে কবিমন গেয়ে ওঠে, আজি ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা, নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা। শরতের রূপটাই এমন, যে রূপে সাধারণের মনটাও ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে। অবসাদগ্রস্ত মনটাতেও নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। তবে শরতের দুই মাসের আবার দুই রকম মেজাজ। কখনো ইলশেগুড়ি বৃষ্টি, কখনো অসহনীয় গরম নিয়ে আসে ভাদ্র। কোথাও কোথাও এই মাস ‘তালপাকা ভাদ্র’ নামে পরিচিত। আবার এই ভাদ্রতেও ঝরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ। প্রবীণেরা বলেন ‘পচা ভাদ্দের’। তবে আশ্বিনে রাত তাড়াতাড়ি আসে। শীতল হতে থাকে আবহাওয়া। শোনা যায় হেমন্তের পদধ্বনি। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাদ্র থেকে আশ্বিনের বন্দনাই বেশি করেছেন। পদ্মায় নৌকাভ্রমণকালে শরতের নীল আকাশ দেখে কবির মন আপনা-আপনি গেয়ে উঠেছে, অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া। প্রকৃতির রানি শরৎ ফুলেরও ঋতু। অনুভূত হয় শরতের ছোঁয়া। এ ঋতুর রয়েছে আদিগন্ত সবুজের সমারোহ। গাছে গাছে শিউলির মন ভোলানো সুঘ্রাণে এ সময় ফোটে গগণ শিরীষ, ছাতিম, বকফুল, শেফালি, শিউলি, কলিয়েন্ড্রা, বেলি, দোলনচাঁপা, বকুল, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কাশফুল, মাধবী, মল্লিকা, মালতী ইত্যাদি। যারা শরতের সঙ্গী হয়ে মন ভরায় সৌন্দর্যপিপাসুদের। কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথায়, এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে। এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে। শরতের অন্যতম আকর্ষণ কাশফুল। নদী তীরে বনের প্রান্তে কাশফুলের রাশি অপরূপ শোভা ছড়ায়। কাশফুলের এ অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার।

শরৎকালে প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে কাশফুল। আর তাইতো কাশবনে ছুটে বেড়ায় দর্শনার্থীরা। সৌন্দর্য উপভোগে মেতে ওঠে প্রকৃতি প্রেমীরা। গগণে শুভ্র মেঘের ভেলা আর নদীতটে সাদা কাশফুল, মালার মতো আকাশগঙ্গায় উড়ে চলা পাখির ঝাঁক, সকালবেলা হালকা শিশিরভেজা সবুজ ঘাস আর শিউলিতলায় সুঘ্রাণ মাখানো শিউলিফুল, নরম রোদের ঝলমলে আলো। সব মিলিয়ে শরৎ যেন নির্মলতার ঋতু। শরতের রাতে দেখা মেলে জ্যোৎস্নার মোহনীয় রূপ। সাহিত্যের অনেকাংশজুড়ে আছে শরৎকাল যার সবটুকুই উৎসব আর আনন্দের। এ সময় বুড়োবুড়িরা ছোটদের কিচ্ছা শোনায় জ্যোৎস্না রাতে। শরৎ উৎসবেরও ঋতু। শিউলির মিষ্টি সুবাসে যেন দেবী দুর্গার আগমনকে ইঙ্গিত দিতে থাকে। শরতের মূল আকর্ষণ দুর্গাপূজা। যা বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব। সমগ্র বাংলাজুড়ে পালিত হয় এ উৎসব। শরৎকালে এ পুজো হয় বলে দুর্গাপূজাকে শারদীয় উৎসব বলা হয়। এ ঋতুতে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে। দেবী দুর্গার আগমনের জন্য তারা সারাবছর অপেক্ষায় থাকে। সেই অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে দেবী দুর্গা শরতের আশ্বিনে নিয়ে আসেন অনাবিল আনন্দ। বাংলার আকাশে বাতাসে মুখরিত হয় দেবী দুর্গার আগমনধ্বনি। উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে বাংলার মানুষজন। পূজোর সময়ে স্কুলে ছুটি থাকায় ছোটদের মধ্যে আনন্দের সীমা থাকে না।

বাংলার প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা ছাড়াও এসময়ে লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা উদযাপিত হয়। পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গার আরাধনা ও বিসর্জন শেষে আগমন ঘটে ধনদাত্রী দেবী লক্ষ্মীর। কিছুদিন পরই রাতের আকাশে আতশবাজির ঝলকানি নিয়ে আসে দীপাবলি উৎসব। শরতের এই সময়ে গ্রামীণ বধূরা নাইওর, অর্থাৎ পিত্রালয়ে গমন করেন। অনেকের মতে, শরৎকালে নাকি ভালোলাগার অনুভবে মনটা নেচে ওঠে। ছুটির নেশা, উৎসবের নেশায় মন ছুটে যায়। হেমন্তকে বলা হয় ফসলের ঋতু। আর শরৎ হলো ফসল সম্ভাবনার। কৃষিনির্ভর বাংলার বুকে প্রাপ্তির আশা জাগিয়ে তোলে শরৎ। কৃষকরা নবান্নের আশায় দিন গোনেন। কারণ, এ শরৎকালে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলমলে রূপ দেখা যায়। দুর্বা ঘাস ভিজে যায় হালকা শিশিরে। চারদিক আমন ধানের সবুজ চারার ওপর ঢেউ খেলে যায় উদাসি হাওয়া। প্রতীক্ষায় থাকে কৃষকরা। আসন্ন নবান্নের আশায়। বিলের জলে নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে সাদা ও লাল শাপলা।

এ সময় ফল হিসেবে পাওয়া যায় আমলকি, জলপাই, জগডুমুর, তাল, অরবরই, করমচা, চালতা, ডেউয়া ইত্যাদি। আকাশ থেকে কল্পলোকের পরিরা ডানা মেলে নেমে আসে আমাদের পৃথিবীতে। মোটকথা, শরতের দিন-রাতের মনকাড়া সৌন্দর্য বাংলার মানুষজনকে মোহিত করে। আর এ কারণে বলাই যায় শরৎ বাংলার ঋতু-রূপের রাজকুমারী। তবে শরৎ যেন দিন দিন হয়ে উঠছে বইয়ের পাতার বাসিন্দা। নাগরিক জীবন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ছুটছে, যখন রুটিরুজির সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত অনেকেই, তখন শরতের অপরূপ বিভা দেখার ফুরসত কোথায়। তাছাড়া যে কাশফুল শরতের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে, দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সেই কাশফুলের বন। গড়ে উঠছে গগনচুম্বী ইমারত। শরতের সৌন্দর্যের উৎসগুলো হারিয়ে যাচ্ছে নগরায়নে। এগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে বলে মনে করেন প্রকৃতিপ্রেমীরা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট