বিভাগ বর্জিত এসএসসি পরীক্ষা

কী পড়বে শিক্ষার্থীরা, সে সিদ্ধান্ত কোথায়

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আকস্মিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন থাকছে না। চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো আলাদা বিভাগ বেছে নেওয়ার সুযোগ বন্ধ হচ্ছে। সব শিক্ষার্থী পড়বে একই পাঠ্যবই। ২০২৫ সালে এ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা যখন দশম শ্রেণিতে উঠবে, তখন সেখানেও বিভাগ বিভাজনের সুযোগ থাকবে না। আর ২০২৬ সালে এসব শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। সেখানে সবার পরীক্ষার বিষয় ও প্রশ্নপত্র একই থাকবে। মূল্যায়ন করা হবে সূচক বা চিহ্নভিত্তিক। এ ধরনের তথ্য গণমাধ্যমে আসার পর অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ বেড়ে গেছে। কেননা যেসব ছাত্র প্রকৃত অর্থে মেধাবী তারা তো বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করার ইচ্ছা পোষণ করেন। তারা ভবিষ্যতে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবে সেই লক্ষ্য থেকেই তারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। যারা আর্থিক খাত-ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা ব্যাংক বীমায় কাজ করতে আগ্রহী তার বাণিজ্য বিভাগে আর অন্যরা অন্য বিভাগে পড়ালেখা করে তাদের জীবন গড়ে তুলবে। তবে পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত অনুসারে এখন শিক্ষার্থীরা কি পড়বে, কেন পড়বে এবং এসব বিষয় পড়ে তারা ভবিষ্যতে কি হবে, জ্ঞান বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হবে নাকি রান্না বান্না ও চারুকলায় সমৃদ্ধ হবে সে বিষয়টি খোলাসা করা হয়নি। সব বিভাগ বন্ধ করে একক স্বত্তা নিয়ে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কি করবে সেটা তো বোধগম্য করতে হবে। সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তো কোনো একক ব্যক্তি বিশেষ কিংবা মুষ্টিমেয় মানুষের চিন্তা-চেতনার ফসল নয়। যেখানে সারা দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন না ঘটবে সেখান থেকে সফলতা অর্জন করা সহজ হয় না। অথচ কি হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে কেন যেন বিজ্ঞান গবেষণাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কি ফলাফল আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় অর্জন করতে চায় সেটা কেন যেন অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। সন্তানের শিক্ষাজীবন নিয়ে আমাদের অভিভাবকরা এমনিতেই উৎকণ্ঠিত। কেননা সব অভিভাবক সমান জ্ঞানের অধিকারী নন। তাদের চিন্তা-চেতনার ঘাটতি রয়েছে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীরাও খানিকটা ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। এই ধোঁয়াশা দূর করা দরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছা হলো কোনো বিভাগ থাকবে না। বিভাগ থাকা না থাকার বিষয়টি শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিষয়। একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অনেক কিছু চিন্তা-ভাবনা করতে হয়। বাস্তব ও পারিপার্শি¦কতা নিয়ে পর্যালোচনা করতে হয়। হঠাৎ করে একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি শিক্ষাঙ্গনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে দুর্ভোগ বাড়ে। গত ২৩ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব (সরকারি মাধ্যমিক-২) সাইয়েদ এ জেড মোরশেদ আলীর সই করা বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, মাধ্যমিক পর্যায়ে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে নবম শ্রেণিতে বিভাগ (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা) বিভাজন না থাকার বিষয়ে মাঠপর্যায়ে পত্র জারির প্রশাসনিক অনুমোদন নির্দেশক্রমে প্রদান করা হলো। গত মাসে প্রকাশিত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক স্মারকের সূত্রে এ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। জানা গেছে, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় নতুন কারিকুলাম প্রণয়নের জন্য ২০১৬ সালে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। একই বছরের ২৫-২৬ নভেম্বর কমিটির সদস্যরা কক্সবাজারে দুই দিনের আবাসিক কর্মশালায় অংশ নেন। এতে শিক্ষাবিদরা বেশ কিছু সুপারিশ প্রস্তাব করেন। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য কয়েকটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়। এর একটি শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা সাব-কমিটি। এ কমিটি ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর ৮ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে একটি হলো পাঠ্যবইয়ের কিছু বিষয় বাধ্যতামূলক এবং কিছু বিষয় ঐচ্ছিক রাখা। এছাড়া বর্তমানে চালু থাকা তিন বিভাগের প্রায় সব বিষয় সব শিক্ষার্থীই যেন পড়তে পারে, সেভাবে কারিকুলাম প্রস্তুত করা। এরই অংশ হিসেবে চলতি বছর (২০২৩) প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০২৪ সালে চালু হবে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। ২০২৫ সালে চালু হবে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে। উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে চালুর মধ্য দিয়ে পুরোপুরিভাবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্তে নবম শ্রেণিতে কোনো বিভাগ থাকবে না। সবাই একই শিক্ষাক্রমে লেখাপড়া করবে। প্রশ্ন হচ্ছে সেই শিক্ষাক্রমে কি পড়ানো হবে সেটি নিয়ে কোনো শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক কোনো ধারণা পাচ্ছেন না। শিক্ষামন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যে সিদ্ধান্ত নেয় তা সাধারণ মানুষের কাছে কতটা বোধগম্য সেটাও ভাবা দরকার। বিভাগ ছাড়া শিক্ষার্থীরা কি কি বিষয়ে পড়ালেখা করবে সে বিষয়টিও পরিষ্কার করা হয়নি। এরইমধ্যে কয়েকটি শ্রেণিতে যে শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে তাতে কঠিন সমস্যায় পড়েছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। স্কুল থেকে বাড়িতে আসার পর চারুকলা ও রন্ধন শিল্প নিয়ে শিক্ষার্থী অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছে। নামি-দামি কাগজে আঁকাআঁকি কিংবা ভৌত কোনো স্থাপনা কাগজ দিয়ে তৈরি করার যে কসরৎ শিক্ষার্থীরা করছে তাতে অভিভাবকরা মহা বিরক্ত। দিনে রাতে যে কোনো সময় আট পেপার, রঙ-পেন্সিল, আঠা কিংবা আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনতে কিনতে অভিভাবকদের পকেট খালি হয়ে যাচ্ছে। কাগজ দিয়ে বড় বড় স্থাপত্য শিল্প তৈরি করার শিক্ষা নিয়ে একজন ছাত্র ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। শিক্ষার্থীরা মায়েদের রান্না করা নাস্তা জাতীয় খাবার স্কুলে নিয়ে নিজের বলে চালিয়ে দিয়ে চৈৗর্য্যবৃত্তির আশ্রয় নিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া শিখে চাকরি করবে, সংসার পরিচালনায় অর্থ জোগান দেবে সেটাই তো হওয়া উচিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা চারুকলা ও রন্ধন শিল্প রপ্ত করে ভবিষ্যতে কি করবে সেটা কি শিক্ষামন্ত্রণালয় একবারও ভেবেছে কি না জানি না। আমাদের দেশের দায়িত্বশীল কেউ কেউ বিদেশ গিয়ে সেইসব দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দেখে বুঝে কিংবা না বুঝে তা বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করতে চায়। একেকটা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা আর বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এক নয়। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা না করে অবাস্তব ও কল্পনাপ্রসূত ব্যবস্থা যে কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলেও শিক্ষা খাতে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে অনেক ভেবে চিন্তে নিতে হবে। শিক্ষাঙ্গনকে কখনো পরীক্ষার গিনিপিক করা যাবে না। কেননা সেখানে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। তাই কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেয়াই বাঞ্চনীয়।