ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঢাকায় আতঙ্কজনক বায়ুদূষণ

সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য নীরব ঘাতক
ঢাকায় আতঙ্কজনক বায়ুদূষণ

বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় গতকাল ঢাকার অবস্থান ১৩তম স্থানে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোর ছিল ১২৭। এই মানকে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর বলে নির্দেশ করে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার দূষিত বাতাসের শহরের তালিকা প্রকাশ করে থাকে। বায়ুদূষণ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এটা সববয়সি মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তবে শিশু, অসুস্থ ব্যক্তি, প্রবীণ ও অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য বায়ুদূষণ খুবই ক্ষতিকর। বায়ুদূষণ বর্তমান বিশ্বে বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। ১৯৯৮ সালের তুলনায় বায়ুদূষণ ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বায়ু দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪৮ লাখ মানুষ সারা বছর দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানমাত্রা, প্রতি ঘনমিটারে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। শিশুদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। ঢাকার বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ৪৮ দিন ছাড়া বছরের বাকি ৩১৭ দিন ঢাকার বাতাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্মল বায়ুর মানমাত্রার চেয়ে খারাপ থাকে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শীতকালে ঢাকার বাতাস ১৬ গুণ বেশি দূষিত থাকছে।

গত জানুয়ারিতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দিন দুর্যোগপূর্ণ বাতাসের মধ্যে কাটিয়েছে নগরবাসী। জানুয়ারিতে মোট ৯ দিন রাজধানীর বাতাসের মান দুর্যোগপূর্ণ ছিল, যা সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বর্ষার সময় সাধারণত বায়ুদূষণ কম থাকে। কিন্তু এবার বর্ষা মৌসুম বা জুলাই-আগস্টে বায়ুদূষণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এমনকি গত আগস্টে বায়ুদূষণ ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। ঢাকার চারপাশের ইটের ভাটায় নিম্নমানের কয়লা পোড়ানো এবং ঢাকা নগরীর গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা-ঘাট খোঁড়াখুঁড়ি; রাস্তার পাশে আবর্জনার স্তূপ; মেরামতহীন ভাঙাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকে অতি মাত্রায় বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার নির্গমন, ভবন নির্মাণ ও ভাঙার সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী বাইরে রাস্তা-ফুটপাতে যত্রতত্র ফেলে রাখা, মেশিনে ইট-পাথর ভাঙা এবং শিল্প-কারখানার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও ধুলাবালি বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। একজন সুস্থ স্বাভাবিক লোক গড়ে ২,০০,০০০ লিটার বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে। দূষিত বায়ুর কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা থেকে ক্যান্সার হতে পারে, যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। স্ট্রোক, হৃদরোগ; ফুসফুস, স্তন, মূত্রথলির ক্যান্সার; সিওপিডি, হাঁপানি, ফুসফুস সংক্রমণ; চর্মরোগ, অ্যালার্জি; ৯ ধরনের চোখের অসুখ; সংক্ষিপ্ত গর্ভাবস্থা, বন্ধ্যাত্ব, অনিয়মিত ঋতুচক্র; শিশুর জন্মকালীন রুগ্নতা ও বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া; স্নায়ু বৈকল্য, ডিমেনশিয়া, আলঝেইমারস; অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির ক্ষতি, টাইপ-২ ডায়াবেটিসসহ বহু রোগের সঙ্গে বায়ু দূষণের সম্পর্ক রয়েছে।

অতিরিক্ত বায়ু দূষণের খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর। একই সঙ্গে যেসব এলাকায় বায়ুদূষণ বেশি, সেইখানের মানুষ বেশি মাত্রায় বিষণ্ণতায় ভুগছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রা থেকে ১ শতাংশ দূষণ বাড়লে বিষণ্ণতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ২০ গুণ বেড়ে যায়। বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। দেশের বায়ুদূষণপ্রবণ এলাকায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। দেশে যক্ষ্মা ও এইডসের মতো রোগের চেয়ে বায়ু দূষণজনিত রোগে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। হঠাৎ এতে মৃত্যু না হলেও তা ধীরে ধীরে নানা রোগে রাজধানীবাসীকে আক্রান্ত করছে। ফলে এটি এই শহরের অধিবাসীদের জন্য নীরব ঘাতক হয়ে উঠছে। বায়ুদূষণ শুধু মানুষের ক্ষতি করছে না। গবেষকরা বলছেন, বায়ু দূষণের ফলে গোটা জীবজগৎ এবং বাস্তুতন্ত্রেরও ক্ষতি হচ্ছে। বায়ু দূষণের কারণে প্রতিবছর পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফসল উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত