তামাকদ্রব্য ব্যবহার পরিবেশ ধ্বংসকারী কর্মকাণ্ড!

স্থপতি ইকবাল হাবিব

প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যে জমিতে তামাক চাষ হয়, পরে সেখানে অন্য ফসলের প্রত্যাশিত উৎপাদন হয় না। অর্থাৎ যে জমিতে গড়ে ১৪-১৫ মণ ধান উৎপাদন হতো, সেই জমিতে তামাক চাষ হলে পরে তা থেকে গড়ে ৫-৬ মণ ধানের উৎপাদন কমে যায়। যা আমাদের মতো দেশের পরিবেশ এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। সেই হিসেবে অতীতের নীল চাষের সঙ্গে তামাক চাষের কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। পরিবেশ দূষণে তামাক পণ্যের ব্যবহারের ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। দুনিয়াজুড়ে যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তামাক পণ্যের ব্যবহারের ফলে যে পরিবেশের ক্ষতি হয়, তা অস্বীকার করবে না। এমনকি খোদ তামাকদ্রব্য উপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও। বাংলাদেশ সেদিক থেকে ব্যতিক্রম নয়। বরং বাংলাদেশ তামাক উৎপাদনে বিশ্বের ১৩তম এবং বিশ্বব্যাপী মোট তামাক উৎপাদনের ১.৩ শতাংশ তামাক উৎপাদন করে। এ দেশে তামাক চাষেরও রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাকদ্রব্যের বেশ কয়েকটি ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে তামাকের একটি জীবনচক্র নির্ধারণ করে। যেখানে দেখা যায় যে, তামাকদ্রব্য উৎপাদনের জন্য প্রতিবছর গড়ে ১১.৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন কাঠের প্রয়োজন হয়, যেগুলোর জন্য প্রচুর পরিমাণে গাছ ও বন উজাড় করারও প্রয়োজন পড়ে। এ প্রক্রিয়ায় ১৯৭০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত দুনিয়া থেকে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন হেক্টর বন এই তামাকদ্রব্য উৎপাদনের কবলে পড়ে হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশ একটি ‘ধূমপানাসক্ত জনগণের দেশ’ হিসেবে পরিবেশের জায়গা থেকে যথেষ্ট বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। এ দেশের গাছপালা-বন উজাড়করণের মধ্যে ৩১ শতাংশই হয় তামাক চাষের ফলে। প্রতিবছর ৬৯ হাজার হেক্টর জমি কৃষি খাত থেকে বিবিধ কারণে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া গত কয়েক বছরের খাদ্য ও কৃষি ইনস্টিটিউটের জরিপ মতে, বাংলাদেশে কৃষকরা তামাক চাষের দিকে ঝুঁকছে, কারণ এতে অর্থনৈতিকভাবে তাদের আপাত লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফলে প্রচুর পরিমাণ উর্বর জমি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে, একই সঙ্গে জমি এবং নদীনালার পানির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অধীনে জাতীয় তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করে, যেই নীতির মূল লক্ষ্যই ছিল চাষিদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করা এবং তাদের অন্যান্য দরকারি ফসল চাষে উৎসাহ দেওয়া আর সেই লক্ষ্যে সহায়তা প্রদান করা। এর পাশাপাশি তামাক উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো যেন চাষিদের তামাক চাষে প্রলুব্ধ করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু গৃহীত সেই নীতির কোনো আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়নি। বরং এখন দিনকে দিন বাংলাদেশে তামাক চাষের পরিমাণ বাড়ছে। তাই বোঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। ফলে তামাকদ্রব্য ব্যবহার সম্পর্কিত আইন ও নীতিমালার দিকে বেশ জোর দেওয়া প্রয়োজন, যদিও বাংলাদেশে তামাকদ্রব্য ব্যবহার সম্পর্কিত আইন ও নীতিগুলো যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। এ দেশে সর্বপ্রথম ২০০৫ সালে তামাকদ্রব্য ব্যবহার নিয়ে আইন প্রণয়ন করা হয়, যেখানে উন্মুক্ত জনপরিসরে ধূমপানকে সীমাবদ্ধ করা হয়, ধূমপানের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হয় এবং পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে সিগারেটের প্যাকেটের ওপর ধূমপানের ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর দিকগুলো উল্লেখ করে দেওয়ার কথা বলা হয়। পরে ২০১৩ সালে ওই আইনের সংশোধনী আনয়ন করা হয়। সংশোধিত আইনটিতে আগের আইনের সবকিছু বহাল রেখে একে মুখ্য তামাকদ্রব্য ব্যবহার আইন হিসেবে গ্রহণ করা হয়, পাশাপাশি সিগারেটের প্যাকেটের ওপর ধূমপানের ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর দিকগুলোর একটা চিত্রলেখ দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এত বছর পরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে শতকরা ৩৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাকদ্রব্য ব্যবহার করছে তা মূলত সিগারেট এবং অন্যান্য মাধ্যমে। কর্মক্ষেত্রে এবং বাসায় যথাক্রমে শতকরা ৪৩ শতাংশ এবং ৩৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পরোক্ষভাবে ধূমপান করছে। এ ছাড়া ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সের কিশোরদের শতকরা সাত শতাংশই তামাকদ্রব্য ব্যবহার করে। সেই হিসেবে বাংলাদেশে মোট ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাকদ্রব্য ব্যবহার করে। আর এ কারণেই বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক ধূমপায়ী দেশের মধ্যে একটি। এই সংখ্যা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উপরোক্ত তথ্য থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে, আমাদের জাতীয় গণস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ কী পরিমাণ হুমকির মুখে আছে। ধূমপান এবং অন্যান্য উপায়ে তামাকদ্রব্য সেবন নিয়ন্ত্রণে আনা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। তামাকদ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিদ্যমান যে আইন রয়েছে তার বেশকিছু সীমাবদ্ধতাও লক্ষ্য করা গেছে। যেমন ২০১৩ সালের আইনে ‘জনপরিসর’কে সংজ্ঞায়িত করা হলেও ধূমপানের নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে ধূমপান করার অনুমতি আছে। এই বিভিন্ন নির্ধারিত স্থানে ধূমপান করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ছাড়া জনপরিসরে ধূমপানকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে লিখিতভাবে গ্রহণ করলেও সেটার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় না। বায়ুদূষণ থেকে শুরু করে পরিবেশের নানা উপাদান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শতকরা ১৯-৩৮ শতাংশ সমুদ্রের বর্জ্য হলো সিগারেটের খোসা এবং প্যাকেট। তামাকের উন্মুক্ত ব্যবহারের ফলে এই যে গোটা দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকির মুখে সে বিষয়ে জনসচেতনতা কতটুকু আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। মানুষ কতটুকু জানে বা জানতে পারছে, তা নিয়েও প্রশ্ন থাকছে। সম্প্রতি সরকার তামাকদ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুন করে ভাবা শুরু করেছে, যেটার প্রতিফলন হলো তামাকদ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইনে নতুন সংশোধনী আনতে একটি খসড়া কেবিনেটের পর্যালোচনায় রয়েছে। সংশোধনের ফলে ছয়টি নতুন প্রস্তাবনা ঘোষণা করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে নির্ধারিত ধূমপানের স্থানের ধারণাটি বাতিল করা অর্থাৎ জনপরিসরে ধূমপানকে নিষিদ্ধ করা, তামাক উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর যে সামাজিক কর্মকাণ্ড রয়েছে তা নিষিদ্ধ করা, বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে তামাকদ্রব্যের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করা, সব ধরনের বৈদ্যুতিক সিগারেটের আমদানি, উৎপাদন, ব্যবহার এবং বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা এবং সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে স্বাস্থ্যের ঝুঁকির চিত্র আরো বাড়ানো। এগুলোর পাশাপাশি ধূমপান ও অন্যান্য উপায়ে তামাকদ্রব্য ব্যবহারের ফলে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ কী পরিমাণ বিপদের মুখে আছে এ বিষয়ে যতটা সম্ভব জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। বিভিন্ন পরিসরে এই সচেতনতাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা। বাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও সব ধরনের জনপরিসরে থাকা প্রতিষ্ঠানে ধূমপান ও তামাকদ্রব্য ব্যবহারের ফলে পরিবেশের বিপজ্জনক বিষয়গুলোকে তুলে ধরা এবং তামাকদ্রব্য ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার প্রক্রিয়া গড়ে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। এটাকে একটি সামাজিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শুধু সংশোধন নয় বরং কঠোর আইনের অধীনে নিয়ে আসা। ২০৪০ সালের মধ্যে যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ করার ভিশন রয়েছে, তা কখনই অর্জন হবে না, যদি না এখন থেকেই জনস্বাস্থ্য, কৃষিজমি সংরক্ষণ, নদীনালা ও খালবিলের পানি তামাকের বর্জ্যমুক্ত রাখা, অভ্যন্তরীণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বাঁচানোর লক্ষ্যে প্রস্তাবিত আইনের সংশোধনটির দ্রুত পাস না হয় এবং তাকে যথাযথ উপায়ে কঠোরভাবে কার্যকর নিশ্চিত না করা হয়।

লেখক : সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, বাপা।