তুলার উৎপাদন বৃদ্ধিতে আরো উদ্যোগ নিতে হবে

রত্না খাতুন

প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো হলো- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। সভ্যতার দিক থেকে বিবেচনায় বস্ত্রই হচ্ছে আমাদের প্রথম মৌলিক চাহিদা। এই বস্ত্রশিল্পের প্রধান উপাদান তুলা। তুলা Malvaceae গোত্রের গণের আঁশ উৎপাদনকারী অর্থকরী ফসল। এটি একটি আন্তর্জাতিক মানের শিল্প ফসল যা বিশ্বব্যাপী ‘সাদা স্বর্ণ’ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বে প্রায় ৭৫টি দেশে তুলা চাষ করা হয়। তুলা উৎপাদনে প্রতিনিধিত্বকারী দেশগুলোর মধ্যে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও ব্রাজিল অন্যতম। বিশ্বের প্রায় ২৬ শতাংশ তুলা ভারত ও ২২ শতাংশ তুলা চীনে উৎপাদিত হয়। তুলা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম ও তুলা আমদানিকারক দেশ হিসেবে দ্বিতীয়। যেসব দেশ থেকে তুলা আমদানি করা হয় তা হলো আফ্রিকা থেকে ৩৭ শতাংশ, ভারত থেকে ২৬ শতাংশ, সিআইএস দেশগুলো থেকে ১১ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১১ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া থেকে ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে ১০ শতাংশ। তুলার ইতিহাস পৃথিবীতে ৭ হাজার বছরের পুরোনো। তুলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের দেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস, সভ্যতা, অর্থনীতি। এক সময় বাংলাদেশের মসলিন ছিল বিশ্ববিখ্যাত। এ মসলিনের তুলা এ দেশেই উৎপাদিত হতো। আর্যদের যুগ থেকে ব্রিটিশ আমলের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কার্পাসের চাষ হতো, চরকায় সুতা তৈরি হতো, তাঁতিরা কাপড় বুনে দেশের চাহিদা মেটাতেন। বিশ্ববিখ্যাত মসলিন কাপড় ও অন্যান্য সুতি বস্ত্র পুরো ইউরোপে রপ্তানি হতো, বিনিময়ে এসেছে বহু মূল্যবান ধাতু। ওই সময় বাংলাদেশের নিতান্ত দীন-হীন নারী-পুরুষের গায়েও দেখা যেত স্বর্ণ-রুপার আংটি, অলঙ্কার, মন্দিরে মন্দিরে, দেব-দেবীর স্বর্ণমূর্তি। ড. আলি নওয়াজের ‘খনার বচন, কৃষি ও বাঙালি সংস্কৃতি’ বই থেকে জানা গেছে, ম্যানচেস্টারের কাপড় বাংলাদেশি কাপড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারত না বলে ইংল্যান্ডে বাংলাদেশি কাপড় নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের ঔপনিবেশিক নীতির ফলে শুধু যে কার্পাস চাষ আর তাঁতশিল্পই ধ্বংস হয়, তা নয়। এ দেশের কৃষককে বাধ্য করা হলো তৎকালীন বিশ্বের কারখানা ইংল্যান্ডের কল-কারখানার জন্য কাঁচামাল প্রস্তুত করতে। এর উদাহরণস্বরূপ নীল চাষের উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের তাঁতশিল্পকে ধ্বংস করে, তাঁতিদের বাড়ি বাড়ি সিপাহি বসিয়ে তাঁত চালানো বন্ধ রাখা হতো। এ নিয়ে দুইবার তাঁতি বিদ্রোহ হয়েছিল। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশের তুলা চাষ স্থানান্তর হয় ইংরেজদের নির্ভরযোগ্য উপনিবেশ আমেরিকায় আর আমেরিকার নীল চাষ আনা হয় বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায়। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান নামক দুটি দেশের সৃষ্টি পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতাণ্ডপূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো তুলা উৎপাদন হতো না। সব তুলা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হতো। স্বাধীনতা লাভের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন। পাট চাষের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নেওয়া ৩২৫ চাষিকে স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলে ৭৯৬ একর জমি তাদের মধ্যে তুলা চাষের জন্য বরাদ্দ প্রদান করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে তুলা চাষের শুভসূচনা ঘটে।

তুলা চাষে সুবিধা : তুলা ফসলের উৎপাদনকাল ৫ থেকে ৬ মাস। তাই একক ফসল হিসেবে তুলা চাষ বর্তমানে যথেষ্ট লাভজনক। তবে তুলা ফসল ওঠার পর অঞ্চলভেদে আরেকটি ফসল যেমন- গ্রীষ্মকালীন পাট, মুগ, তিল, বীজের জন্য বাদাম ইত্যাদি চাষ করা সম্ভব। প্রচলিত পাট চাষ আর বর্তমানে গ্রীষ্মকালীন মুগ ও তিল চাষ এখন যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে। আবার তুলা ফসলের সঙ্গে সাথী ফসল চাষের সুযোগও আছে। যেহেতু তুলার সারি থেকে সারি কমপক্ষে তিন ফুট (৯০ সেন্টিমিটার) থাকে, সেহেতু মাঝের ফাঁকা জায়গা থেকে সহজেই এক-দুই মাসের মধ্যে সবজি ও শাকজাতীয় বিভিন্ন ফসলের চাষ করা যায়। সাথী ফসলের আয় থেকে তুলা চাষের উৎপাদন খরচের অনেকটাই পূরণ হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে এক সারি অন্তর সাথী ফসলের চাষ করতে হয়- যাতে তুলা ফসলের পরিচর্যায় কোনো সমস্যা না হয়। তুলা বীজ থেকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ তেল পাওয়া যায়- যা সয়াবিন তেলের চেয়েও পুষ্টিকর। বর্তমানে ভোজ্যতেলের সমস্যায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া তুলা বীজের খৈলে রয়েছে ২৪ শতাংশ প্রোটিন আর ২০ শতাংশ ফ্যাট- যা গবাদিপশু ও মৎস্য খাদ্যের জন্য উৎকৃষ্ট। তুলা বীজের গায়ে লেগে থাকা ফাঁজ ডাক্তারি কাজে ব্যবহার করা হয়। তুলাগাছ জ্বালানির একটি ভালো উৎস। দেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও যশোর জেলা তুলা চাষের প্রধান এলাকা। অধিকাংশ পরিমাণ তুলাই এসব এলাকায় উৎপাদিত হয়। তবে প্রয়োজন ও ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তুলা চাষ প্রসারিত হয়নি। আমরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় তুলা উৎপাদনে পিছিয়ে আছি। ফলে তুলাশিল্পের উন্নয়ন বস্ত্রশিল্পে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। চলতি মৌসুমে (২০২২-২৩) সারা দেশে ৪৮ হাজার হেক্টরে তুলা চাষের কর্মসূচি নিয়েছে তুলা উন্নয়ন বোর্ড। তুলার উৎপাদন ও লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার বেল। গত বছর দেশে ১ লাখ ৯৬ হাজার বেল তুলা উৎপাদন হয়েছিল। বর্তমানে দেশে ৮০ লাখ বেল তুলার চাহিদা রয়েছে। দেশে গার্মেন্টশিল্প প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে তুলার চাহিদা। দেশে পুরোপুরিভাবে জোগান দিতে না পারায় আমদানি করতে হয়। তবে সাম্প্রতিককালে হাইব্রিড ও উচ্চফলনশীল জাতের তুলা আবাদের ফলে তুলা উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। তা ছাড়া তুলার উৎপাদন বৃদ্ধিতে নানামুখী পরিকল্পনাও করছে সরকার। জানা গেছে, আমাদের দেশে তুলার বার্ষিক চাহিদার মাত্র ২ দশমিক ২৫ শতাংশ পূরণ হয়ে থাকে। তুলা উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এবার ৫ হাজার ১০০ হেক্টরে হাইব্রিড সমভূমির তুলা চাষ করা হবে। তুলার চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশেও তুলা উৎপাদন বৃদ্ধির নানা পরিকল্পনা করা হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংস্থা (ওইসিডি) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়- ২০৩০ সালে বিশ্বে তুলার যত বাণিজ্য হবে, এর ১৮ শতাংশ একা বাংলাদেশ আমদানি করবে। চীনকে টপকে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বিশ্ব তুলার বাজারে। ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ ও ভিয়েতনামে ২৮ শতাংশ সুতি কাপড়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এ দেশে তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে বিপুল অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি পোশাকশিল্পও হবে সমৃদ্ধ। তাই এ সাদা স্বর্ণ তথা তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি আরও জোরদার করতে হবে।

লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।