ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আইএমএফের ঋণ ও আগামীর ভাবনা

রেজাউল করিম খোকন, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
আইএমএফের ঋণ ও আগামীর ভাবনা

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় নিয়ে সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে আইএমএফের পর্ষদ সভায় ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়টি অনুমোদন পাবে। ঋণের জন্য আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি পূরণ হয়েছে। তবে রিজার্ভ ও রাজস্ব আহরণের শর্ত পূরণ হয়নি। এর পেছনে দেশীয় ও বৈশ্বিক যেসব কারণ আছে, সেগুলো আইএমএফের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এর পরই ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। অনুমোদনের পরপরই ঋণের প্রথম কিস্তি হিসেবে বাংলাদেশকে ৪৭৬ মিলিয়ন বা ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার দেওয়া হয়। আইএমএফ সময়ভিত্তিক কিছু লক্ষ্য দিয়েছিল বাংলাদেশকে। তবে দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রিজার্ভ, রাজস্ব আয় ইত্যাদি লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হয়নি। তবে সরকারের দিক থেকে আইএমএফের দলকে শর্ত পূরণ করতে না পারার কিছু কারণ তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের দিক থেকে বলা হয়েছে, আগামী জানুয়ারিতে যেহেতু বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ফলে এ সময়ের মধ্যে লক্ষ্যগুলো অর্জন করার বাস্তবতা নেই। একটু কমিয়ে আগামী জুন পর্যন্ত নতুন লক্ষ্যমাত্রা চাইলে আইএমএফ তাতে সম্মতি প্রকাশ করেছে। নতুন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ রাখতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যে এক হাজার ৮০০ কোটি এবং আগামী জুনের মধ্যে দুই হাজার কোটি ডলার। আইএমএফের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী গত জুনেই বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা দুই হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশের জন্য গত ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে আইএমএফ, যা থেকে ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করে। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার আগে প্রথম কিস্তির মূল্যায়ন করতেই আইএমএফের দলটির এবার ঢাকায় এসেছিল। নতুন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ রাখতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যে এক হাজার ৮০০ কোটি এবং আগামী জুনের মধ্যে দুই হাজার কোটি ডলার। আইএমএফের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী গত জুনেই বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা দুই হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। আর সেপ্টেম্বরের রিজার্ভের লক্ষ্য ছিল দুই হাজার ৫৩০ কোটি ডলার। এ ছাড়া ডিসেম্বরে লক্ষ্য ছিল দুই হাজার ৬৮০ কোটি ডলার। আগের দুটি পারেনি এবং ডিসেম্বরেরটিও বাংলাদেশ পারবে না বলে আইএমএফকে জানিয়েছে। কারণ, বর্তমানে প্রকৃত রিজার্ভ এক হাজার ৭০০ কোটি ডলারের কম। আইএমএফের বরাদ্দকৃত ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া না পাওয়া নিয়ে দারুণ অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তা সৃষ্টি হয়েছিল। আইএমএফের একটি চৌকস দল তাদের বরাদ্দকৃত ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি অনুমোদনের আগে এ সংক্রান্ত শর্তাবলী সঠিকভাবে পরিপালন করা হয়েছে কি না তা যাচাই করতে বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করে। তাদের পর্যবেক্ষণে অনেকগুলো ঘাটতি, ত্রুটিবিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা হয়। বেঁধে দেওয়া রিজার্ভ সঞ্চিতির পরিমাণ, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, সরকারি ভর্তুকি কমানো, ব্যাংক ব্যবস্থায় বিদ্যমান অনিয়ম দুর্নীতি দূরীকরণে সংস্কার কার্যক্রম শুরু, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাসহ সুদহার নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে আইএমএফের প্রেসক্রিপশন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সবকিছু পরিপালন পরিচালনা অনেক কঠিন। ফলে আইএমএফের শর্ত পূরণ অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। তেমন অবস্থায় ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া নিয়ে দারুণ অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। কিছুদিন আগে বেঁধে দেয়া শর্ত পরিপালন করতে ব্যর্থ হওয়ায় শ্রীলঙ্কার ঋণের কিস্তি আটকে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশকেও কী শ্রীলঙ্কার পরিণতি বরণ করতে হয় কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল। আমাদের সৌভাগ্য বলা যায়, বিভিন্ন শর্ত পূরণে ব্যর্থতা, অন্যান্য সীমাবদ্ধতা, ত্রুটিবিচ্যুতিগুলোর নেপথ্য কারণ সম্পর্কে তাদের বোঝানোর চেষ্টায় সফল হয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফ পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেকটা ছাড় দিতে রাজি হয়েছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আটকে দিয়েছে আইএমএফ। মূল্যস্ফীতির হার কমে আসায় শ্রীলঙ্কা নীতি সুদহার ১০০ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে দেওয়ায় শ্রীলঙ্কাকে ঋণের কিস্তি আটকে দেয় সংস্থাটি। আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ঋণের শর্ত কিছুটা শিথিল করছে। ফলে পাওয়া যাবে দ্বিতীয় কিস্তি, যার পরিমাণ ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ এখন কম। তবে আশা করা যায়, স্বল্প মেয়াদে ধারাবাহিকভাবে তা বাড়বে। মধ্য মেয়াদে চার মাসের আমদানির সমপরিমাণও থাকবে এ রিজার্ভ। তবে সংস্থাটি মনে করে, বাংলাদেশের সামনে আছে উচ্চ মাত্রার অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি। তারা বলেছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে বাংলাদেশকে একদিকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে, অন্যদিকে দক্ষতা আনতে হবে খরচ করার ক্ষেত্রে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে যে চাপ পড়েছে সাধারণ জনগণের ওপর, তা মোকাবিলায় অধিকতর মনোযোগী হতে হবে বাংলাদেশকে। শুধু তা-ই নয়, ক্রমবর্ধমান অর্থায়নের চাহিদা মেটাতে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা মোকাবিলা করাও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানো, পুরো ব্যাংক খাতে তদারকব্যবস্থা বৃদ্ধি ও সুশাসনব্যবস্থা জোরদার করলে আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়বে। আর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজারের উন্নয়নও জরুরি। এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয় লক্ষ্যমাত্রা ও বাজেট ঘাটতি কমানো এবং একক মুদ্রা বিনিময় হার চালুর বিষয়ে আইএমএফের কারিগরি সহায়তা পাওয়া যাবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ। আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশ মুদ্রানীতি ও মুদ্রা বিনিময় হারের ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ করতে হবে। সুদের হারের করিডোর পদ্ধতি চালু এবং একক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে সুদহার ও মুদ্রা বিনিময় হারকে পরিপূর্ণভাবে বাজারভিত্তিক করার দিকে নিয়ে যাওয়া। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়ে আইএমএফ বলেছে, অর্থনীতি যেভাবে নানা কারণে ব্যাহত হচ্ছে, তার প্রভাব যেন অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর ওপর তেমন একটা না পড়ে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতি সুদহার দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বৃদ্ধি করেছে, সে জন্য তারা স্বাগত জানিয়েছে। বাংলাদেশ ও আইএমএফের প্রতিনিধিদল ২০২৩ সালের আর্টিকেল ৪ পর্যালোচনা করেছে এবং বর্ধিত ঋণ তহবিল (ইসিএফ), বর্ধিত ঋণ তহবিল (ইএফএফ) এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) অধীনে প্রথম পর্যালোচনা সম্পন্ন করতে যেসব প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণ করতে হবে, সে বিষয়ে ঐক্যমতে এসেছে। সেই হিসাবে দ্বিতীয় কিস্তিতে ইসিএফ ও এফএফের আওতায় ৪৬ কোটি ২০ লাখ এবং আরএসএফের আওতায় ২১ কোটি ৯০ লাখ অর্থাৎ মোট ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাওয়া যেতে পারে। আইএমএফ মনে করে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। আর অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতির হার সাত দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এ সময়ে রিজার্ভ বাড়বে বলে আশা করলেও আইএমএফ উচ্চ মাত্রার অনিশ্চয়তা এবং ঝুঁকি আছে বলেও জানিয়েছে। তবে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়নি। সামাজিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের জন্য রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত অনেক কম, এ পরিস্থিতিতে টেকসইভাবে কর সংগ্রহ বাড়াতে সমন্বিত করনীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রয়োজন। তবে ভর্তুকির যৌক্তিকীকরণ, ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলা করা গেলে সামাজিক নিরাপত্তা খাত ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানোর জন্য যে কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজন হবে, আইএমএফ তাতে সহযোগিতা করবে। বাণিজ্য সম্প্রসারণ, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, বিনিয়োগের পরিবেশ বাড়ানো এবং নারীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতেও সহায়তা করবে আইএমএফ। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং দারিদ্র্য বিমোচনে প্রবৃদ্ধির শক্তিশালী ধারা বজায় রাখতে বাংলাদেশের দ্রুত ও সাহসী অর্থনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জে রয়েছে। এক বছর ধরে অর্থনীতিতে নানা চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আর্থিক লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ পড়েছে, যা রিজার্ভ কমিয়েছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। একই সময়ে একাধিক বিনিময় হার, সুদের হারের সীমা ঠিক করে দেওয়া, ব্যাংক খাতে অপর্যাপ্ত তদারকি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। মানুষের আয় বৃদ্ধির চেয়ে খাবারের দাম বেশি বেড়েছে, যা এ দেশের বহু পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়েছে। নানা অনিশ্চয়তায় বেসরকারি বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে। অবশ্য নির্বাচনের বছরে এমন চিত্র অস্বাভাবিক নয়। এছাড়া জ্বালানির উচ্চমূল্য, কাঁচামালের বাড়তি দাম এবং গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের অভাবে শিল্পোৎপাদন কমেছে। অর্থনীতির এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু স্বল্প মেয়াদি সংস্কার লাগবে। যেমন, নমনীয় বিনিময় হার প্রবাসী শ্রমিকদের বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোয় সহায়তা করবে, আবার প্রবাসী আয়ও বাড়বে। এছাড়া সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া ও মুদ্রানীতি শক্তিশালী করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। একই সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক খাতের সংস্কারে ব্যাংক খাতে শক্তিশালী তদারকি প্রয়োজন। সম্প্রতি মুদ্রানীতিতে কিছু সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখন বাস্তবায়নের গতি দ্রুত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনটি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের রপ্তানি খাত একক পণ্যের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল। তাই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। কারণ, রপ্তানি ও প্রবৃদ্ধির নতুন নতুন চালিকা শক্তি লাগবে। দ্বিতীয়ত, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জনে কার্যকর বিনিয়োগ আনতে হবে। এজন্য আর্থিক খাতের সংস্কার করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। শেয়ারবাজারকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের উৎস হিসেবে পরিণত করা উচিত। তৃতীয়ত, যানজট ও পরিবেশের দুর্বল পরিস্থিতির কারণে নগরায়ণের সুবিধা নেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া অবকাঠামো দুর্বলতা ও মানবসম্পদ নিম্নমানের কারণে প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া শোভন কর্মসংস্থান তৈরি, লিঙ্গবৈষম্য কমানো, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা এসব বিষয়ে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন চাপে পড়লেও আমরা বেশ আশাবাদী। কারণ, এ দেশের অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তি বেশ শক্তিশালী। যেমন, জনসংখ্যা বোনাস, তৈরি পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধি, বিশাল প্রবাসী গোষ্ঠী ইত্যাদি। সময়মতো সঠিক নীতি সংস্কার করতে পারলে আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কোভিডের মধ্যেও আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভালো করেছি। সারা বিশ্বেই এখন অনিশ্চয়তা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও চ্যালেঞ্জ আছে। ব্যাংক খাত ঝুঁকিতে থাকলে পুরো আর্থিক খাত ঝুঁকিতে পড়ে। এই খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা উচিত। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ব্যাংকের সুদের হার ও ডলারের বিনিময় মূল্য বাজারভিত্তিক করা দরকার। সুদের হার বাড়ানো হলে তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। আর ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করা হলে তার সুফল মিলবে প্রবাসী আয়ে। দেশের অর্থনীতি সংকটে পড়েছে কেবল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে নয়। বরং এর জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ছয়টি কারণও দায়ী। এই ছয় কারণ হচ্ছে আবহাওয়াজনিত প্রতিবন্ধকতা (অতিমাত্রায় তাপপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, অপ্রত্যাশিত বন্যা), অনৈতিক ব্যবসা (সিন্ডিকেট, মজুতদারি, মূল্য ঠিক করা, কৃত্রিমভাবে ঘাটতি দেখানো ইত্যাদি), দুর্বল কর্পোরেট পরিচালনা, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সংস্কৃতি, জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো এবং ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং (আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে শুল্ক ফাঁকি ও অর্থ পাচার)। পাশাপাশি বহির্বিশ্বের তিনটি কারণও উল্লেখ করা হয়। সেগুলো হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়া; পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়া; জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণের মূল্যবৃদ্ধি। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি এখন আমাদের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোর পাশাপাশি আরো দ্রুততার সঙ্গে কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। সুদের হার ও ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করতে হবে। ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে কঠোর হতে হবে। ব্যাংকগুলোয় সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক খাত ঠিক করতে বাংলাদেশ ব্যাংক যেন যথাযথ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে, তাও নিশ্চিত করতে হবে। ঋণ কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নীতি সুদহার বাড়িয়ে বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমাতে ‘সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতি’ গ্রহণ এবং খরচ কমানো যেতে পারে।

অর্থনীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে অর্থনৈতিক প্রয়োজনের নিরিখে এবং সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে দ্রুত। সামনে নির্বাচন, এটাকে মাথায় রেখে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে তাতে পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচনের আগে সরকারকে অনেক খরচ করতে হবে, এটি ঠিক। তবে রিজার্ভ যাতে কোনোভাবেই এক হাজার ৫০০ কোটি ডলারের নিচে না নামে, তা খেয়াল রাখতে হবে। নইলে উচ্চ ঝুঁকির কবলে পড়বে বাংলাদেশ এবং আস্থার সংকট দেখা দেবে। আগামী জুন পর্যন্ত আইএমএফের নতুন লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া এবং সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলে পরিণতি কী হতে পারে? এটা মাথায় রাখতে হবে আমাদের। তখন অবধারিতভাবে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি বাতিলের দিকে যাবে। তবে এটি ইতিবাচক যে আইএমএফকে বোঝানো গেছে এবং সংস্থাটি যথেষ্ট সংবেদনশীলতা দেখিয়েছে। ফলে ডিসেম্বর পর্যন্ত আর কোনো শর্ত নেই, সমস্যাও নেই। কিন্তু জুনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কোনোভাবেই যেন ব্যর্থ না হয়, সে ব্যাপারে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন, এবারের মতো তাদের মানানো সম্ভব হলেও আগামীতে কি এভাবে তাদের আরোপিত শর্ত পরিপালনে সীমাবদ্ধতা, অক্ষমতা, অসফলতা, ব্যথতা তারা মেনে নেবে? তারা তো বারবার এভাবে ছাড় দেবে না। তখন যাতে তেমন পরিস্থিতিতে পড়তে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে। তা নাহলে চরম সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হবে। তখন সেটি সামাল দেওয়া কোনোভাবেই হয়তো সম্ভব হবে না। এটি এখন থেকেই মাথায় রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। নির্বাচন ভাবনা থেকে নয়, অর্থনীতির প্রয়োজনের নিরিখে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত দ্রুততার সঙ্গে গ্রহণে করা উচিত। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সুশাসন খুবই জরুরি। এজন্য প্রয়োজন খেলাপি ঋণ কমানো, ব্যাংক খাতের সংস্কার, অর্থ পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। এবার না হয় তবে কোনো ভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে পরিস্থিতি। কিন্তু পরবর্তীতে পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হয়, অর্থনীতিতে আরো শোচনীয় অবস্থা সৃষ্টি হয়, যদি আমাদের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে অধোগতি রোধ করা সম্ভব না হয়, তখন আইএমএফের পরবর্তী ঋণ কিস্তি কীভাবে ছাড় করানো যাবে- সে বিষয়ে আগাম চিন্তা-ভাবনা করার পরামর্শ দিচ্ছি সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত