ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বঙ্গবন্ধু টানেল ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়বে চট্টগ্রামে

মোতাহার হোসেন
বঙ্গবন্ধু টানেল ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়বে চট্টগ্রামে

এশিয়ার প্রথম নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল হচ্ছে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এই টানেল নিয়ে আমরা অনায়াসে গর্ববোধ করতে পারি। বহুল প্রত্যাশীত এই টানেল যানবাহন ও মানুষের জন্য চলাচল উন্মুক্ত হলে দেশের অর্থনীতি, বিনিয়োগ, পর্যটন খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের গৃহীত ১০ মেগাপ্রকল্পের একটি হচ্ছে এটি। ২৮ অক্টোবর শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলটির উদ্বোধন করেন। এই টানেল চট্টগ্রামের সঙ্গে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের মধ্যে সময় ও দূরত্ব কমিয়ে দ্রুত পণ্য পরিবহনে সহায়ক হবে। মূলত এ লক্ষ্যে দেশের এই প্রথম সুড়ঙ্গপথ বা টানেল নির্মিত হলো। তিন দশমিক চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই টানেল মাত্র আড়াই থেকে তিন মিনিটে পার হওয়া যাবে। এই টানেল চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে বন্দরনগরী। এর আগে খরস্রোতা পদ্মা নদীর উপর নির্মিত হয়েছে পদ্মা সেতু, তার পর ওই সেতুর উপর চলছে ট্রেন, ঢাকায় চালু হলো দেশের প্রথম মেট্রোরেল, রাজধানীর ফার্মগেইট থেকে উত্তরা পর্যন্ত নির্মিত দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে এখন চলছে যানবাহন। পায়রা নদীতে নির্মিত হয়েছে দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর। রূপপুরে নির্মাণ যজ্ঞ চলছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। মহেষখালীতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ চলছে দ্রুতগতিতে। এসব কর্মযজ্ঞ শেষ হলেও বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছে যাবে। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য গর্বের এবং অহংকারের। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ও দূরদর্শী ক্যারিশমেটিক লিডারশিপের পরিচয় বহন করে। টানেলের কারণে কর্ণফুলী নদী দ্রুত পেরিয়ে যানবাহন চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই টানেলের লাইফটাইম ১০০ বছর বলা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নদীর তলদেশে এটিই প্রথম টানেল। এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ টানেল যুগে প্রবেশ করল। টানেলের মাধ্যমে চট্টগ্রামের প্রধান নদী কর্ণফুলীর দুই পার এবার যুক্ত হচ্ছে ভিন্নরূপে। নদীর উপরে যেমন নৌযান চলছে, তলদেশেও চলবে মোটরযান। টানেলটি কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে পশ্চিমপ্রান্তে পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির থেকে শুরু হয়ে পূর্ব প্রান্তে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার-কারখানা (সিইউএফএল) এবং কর্ণফুলী সার-কারখানার (কাফকো) মাঝখান দিয়ে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছেছে। এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে একটি বাস গত ২৫ অক্টোবর দুপুর ১টা ৩১ মিনিটে ছেড়ে ঘণ্টায় ১৮ থেকে ২২ কিলোমিটার গতিতে তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ১টা ৩৯ মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছায়। টানেলে সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালানো যাবে। শুরুতে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে চালানোর অনুমতি দিচ্ছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে দুটি টিউব রয়েছে। দক্ষিণ পাশের টিউব দিয়ে আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গামুখী যান চলাচল করবে। পাশেই উত্তরের টিউব দিয়ে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারামুখী যান চলাচল করবে। প্রতি টিউবে দুই লেনের সড়ক ও জরুরি প্রয়োজনে হাঁটার জায়গা রাখা হয়েছে। সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন জানান, কর্ণফুলী নদীর কারণে চট্টগ্রাম এতদিন দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। সেটি এখন যুক্ত হলো। পতেঙ্গা পর্যন্ত এত দিন যে উন্নয়ন হয়ে এসেছে, সেটি এখন টানেলের মাধ্যমে আনোয়ারা প্রান্ত হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। যোগাযোগব্যবস্থা আরো উন্নত হবে। টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য দুই দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের এই অংশ নদীর তলদেশে। টিউবের ভেতরের ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। টিউবসহ মূল টানেলের দৈর্ঘ্য তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার। দুই টিউব তিনটি সংযোগ পথের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে। আপৎকালে এক টিউব থেকে অন্য টিউবে যাওয়ার জায়গা রাখা হয়েছে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘দেশের সড়কব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু টানেল নিঃসন্দেহে ভিন্নমাত্রার একটা উন্নয়ন। এত দিন আমাদের যোগাযোগমাধ্যমে যে সনাতন পদ্ধতি ছিল, সেখানে টানেল একটা ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা হিসেবে যুক্ত হলো।’ একই সঙ্গে বিনিয়োগ, বাণিজ্যে ও পর্যটনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলো। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী এলাকা থেকে পর্যটন নগর কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী এলাকা টেকনাফ। দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তৃত এই জনপদে গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লাভিত্তিক একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পর্যটনশিল্প, এলএনজি টার্মিনাল, জ্বালানি তেলের সিঙ্গল মুরিং প্রজেষ্ট ডিপোসহ বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের উন্নয়ন কাজ চলমান। এসব মেগাপ্রকল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। টানেলটি চালু হলে আপাতত দৈনিক ১৭ হাজার ২৬০ এবং বছরে ৭৬ লাখ যানবাহন চলাচল করতে পারবে। প্রকল্প পরিচালক জানান, ২৪ ঘণ্টা যানবাহন চলাচল করবে কিনা, সে ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী টানেলের প্রথম টিউবের বোরিংকাজ উদ্বোধন করেন। পরের বছর ১২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় টিউবের বোরিংকাজ উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রকল্প ব্যয় ১০ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে চীনের ঋণ ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। বাকি টাকার জোগান দেয় বাংলাদেশ সরকার। টানেলের নির্মাণকাজ করছে চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। টানেলের নিরাপত্তায় ১০০টির বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। টানেলে চলাচলকারী গাড়ির গতিবেগ প্রথম দিকে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের বেশি হবে না। হেঁটে টানেল পার হওয়া যাবে না। একইভাবে মোটরসাইকেল এবং তিন চাকার যানবাহনও চলাচল করবে না টানেল দিয়ে। নির্ধারিত ওজনের বেশি ভারী যানবাহন এ টানেল দিয়ে চলতে দেওয়া হবে না। এজন্য টানেলের প্রবেশমুখে নির্মাণ করা হয়েছে ওজন স্কেল। পরিমাপের পর বেশি হলে ওই যানবাহনকে পার হতে দেওয়া হবে না। বঙ্গবন্ধু টানেল যান চলাচলের জন্য চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। এ টানেলকে দেশের যোগাযোগ খাতে দ্বিতীয় বিপ্লব মনে করা হচ্ছে। টানেলের কারণে পর্যটন নগরী কক্সবাজার, পার্বত্য জেলা বান্দরবান এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে পুরো দেশের সেতুবন্ধ তৈরি হবে। একই সঙ্গে বৃহত্তর চট্টগ্রামে শিল্পায়ন, অর্থনীতি, পর্যটনসহ অন্যান্য খাতে নতুন মাত্রা যোগ হবে। টানেলের মাধ্যমে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর ও মহেশখালীর সঙ্গে যুক্ত হবে পুরো দেশ। এরই মধ্যে দেশের বাণিজ্যিক হাব হিসেবে মহেশখালীকে গড়ে তুলতে তৈরি করা হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্প। নির্মাণাধীনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, এলপিজি টার্মিনাল, অয়েল টার্মিনাল, গ্যাস ট্রান্সমিশন, অয়েল রিফাইনারি, এনার্জি ও ফুড স্টোরেজ, ট্যুরিজম, এমব্যাংকমেন্ট ও ওয়াটারফ্রন্ট ইকোনমিক জোন। এ মেগা প্রকল্পগুলোয় বিভিন্ন এলাকা থেকে পণ্য আনা-নেয়ার জন্য প্রতিদিন চলাচল করবে শত শত গাড়ি; যা বঙ্গবন্ধু টানেল ব্যবহার করবে। টানেলের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। পর্যটনশিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশে এটি ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। বাড়বে রপ্তানি। বঙ্গবন্ধু টানেলটির মধ্য দিয়ে মেগা প্রকল্পগুলোর সুবিধা সংযোগ হয়ে সমগ্র চট্টগ্রামের জীবনমান বদলে যাবে। টানেলটি উদ্বোধন হলে প্রায় ৩৩ হাজার একর ভূমির ওপর মিরসরাইয়ে নির্মাণাধীন স্পেশাল ইকোনমিক জোন, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, চায়না ইপিজেড ও মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দর সংযোগ ও কক্সবাজার এবং তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন সম্ভাবনা বেশ জোরালো হবে। দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে, বাড়বে জীবনযাত্রার মান। কর্ণফুলী নদীর উপর এই টানেল জীবনযাত্রা ও যোগাযোগ বিস্তৃতির ক্ষেত্রে অভাবনীয় ভূমিকা রাখবে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার হয়ে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে এটি। স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে এর অবদান হবে উল্লেখ করার মতো। এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, টানেল পুরোদমে চালু হলে প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি চলাচল করবে। বছরে সে সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৩ লাখে। ২০২৫ সালে টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে; যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। টানেলটির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। শিল্পায়ন ও এশিয়ান হাইওয়ের সংযোগে এই টানেলটি বহুমুখী অগ্রগতির সেতুবন্ধ ঘটাবে। বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে এরই মধ্যে বিনিয়োগের নতুন তৎপরতা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে নতুন শিল্প সম্ভাবনা। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে একের পর এক। শিল্পের কাঁচামাল পরিবহনেও এটি আনবে নতুন যুগ। দেশের অর্থনীতির ‘গেটওয়ে’ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর একদিকে, অন্যদিকে ডিপ সি পোর্ট সংযুক্ত হয়ে ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন গতি আনবে এটি। প্রত্যাশা এর যথাযথ ব্যবহারে মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি, পর্যটন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

মোতাহার হোসেন : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত