ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিতর্কিত কোহিনুর হীরা

প্রদীপ সাহা
বিতর্কিত কোহিনুর হীরা

ব্রিটেনের ৪০তম রাজা হিসেবে তৃতীয় চার্লসের অভিষেক হয়েছে গত ৬ মে ২০২৩। তিনি কোহিনুর হীরা খচিত মুকুটটি ব্যবহার করেছেন এবং মালিকও বটে! এই কোহিনুর হীরার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন রাজবংশের উত্তরাধিকারের সম্পর্ক। এটি যে শুধু প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে আছে তা নয়- এটি চুরি হয়েছে, লড়াইও হয়েছে এটি নিয়ে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, মৃত্যু এবং বঞ্চনার ইতিহাসের কারণে অনেকে এ হীরাকে ‘অভিশপ্ত’ বলে থাকেন। ১০৫ ক্যারেটের ডিম্বাকৃতির এ কোহিনুর পৃথিবীর সবচেয়ে বিতর্কিত ও আলোচিত হীরা। হীরাটি অনেকবার হাত বদল হয়েছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ হীরাটি চলে যায় ব্রিটিশদের দখলে। এটি মুঘল শাহজাদা, ইরানী যোদ্ধা, আফগান শাসক এবং পাঞ্জাবি মহারাজাদের হাত ঘুরে স্থান পেয়েছে টাওয়ার অব লন্ডনে। ক্রাউন জুয়েলসে থাকা ২ হাজার ৮০০টি মূল্যবান রত্নের মধ্যে একটি হলো কোহিনুর। এটি সবসময় এ জায়গায় ছিল না। কালের বিবর্তনে কোহিনুর নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক গল্প। হীরাটি ছিল রানি ভিক্টোরিয়ার বিশেষ সম্পত্তি। তিনি মূলত একটি ব্রোচ হিসেবে এটি পরতেন। শেষ পর্যন্ত এটি ক্রাউন জুয়েলসের অংশ হয়ে ওঠে। ২০০২ সালে কুইন মাদারের মৃত্যুর পর তার কফিনের ওপর এটি সর্বপ্রথম জনসমক্ষে দেখা যায়। অনেক ভারতীয় বিশ্বাস করেন, এ হীরাটি ব্রিটিশরা তাদের দেশ থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। ১৮৪৯ সালে কোহিনুর যখন তৎকালীন ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসির হাতে আসে, তখন তিনি তা রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে পাঠানোর প্রস্তুতি নেন। তিনি ঠিক করলেন, হীরাটির সঙ্গে একটি আনুষ্ঠানিক ইতিহাসও পাঠাবেন। সে অনুযায়ী ইতিহাসের গবেষণার জন্য নিয়োগ দেন দিল্লির একজন জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট থিও মেটক্যাফকে। কিন্তু তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। এর মধ্যেই কোহিনুর সম্পর্কে যেসব গল্পকথা প্রচলিত ছিল, সেগুলোই তিনি তার প্রতিবেদনে আবার উল্লেখ করেন। অথচ এ প্রতিবেদনটিকে কেন্দ্র করেই হাজার হাজার আর্টিকেল ও বই প্রকাশিত হয়েছে; নির্মিত হয়েছে অনেক তথ্যচিত্র। অনেকে কোহিনুরকে ভারতের অন্যতম মূল্যবান হীরা মনে করেন। গবেষকরা দেখেছেন, ১৯০ দশমিক ৩ ক্যারেটের কোহিনুর যখন ব্রিটেনে আনা হয়, তার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ আরো দুটি হীরার খোঁজ পাওয়া যায়। একটি হলো- ‘দরিয়া-ই-নূর’ যার অর্থ আলোর সাগর (১৭৫-১৯৫ ক্যারেট) এবং অপরটি হলো ‘গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড’ হিসেবে পরিচিত অরলভ হীরা (১৮৯ দশমিক ৯ ক্যারেট)। ১৭৩৯ সালে ইরানী শাসক নাদির শাহ যে ধন-সম্পদ লুট করেছিলেন, সে সময় এ তিনটি হীরাই ভারতবর্ষ ত্যাগ করেছিল। শুধু উনবিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে যখন কোহিনুর হাতবদল হয়ে আবার পাঞ্জাবে ফিরেছিল, তখন থেকেই এটি সর্বশ্রেষ্ঠ হীরার পদমর্যাদা পেতে শুরু করে। এটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী বেশ আগ্রহ তৈরি হয়। অনেকেই মনে করেন, প্রকৃত কোহিনুর হয়তো একদম নিখুঁত ছিল। কিন্তু কোহিনুরের ওপর অনেকগুলো হলুদ রঙের দাগ ছিল। কয়েকটি দাগ এত বড় ছিল যে, সেগুলোর কারণে হীরাটি ঠিকভাবে আলো প্রতিফলনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। সে কারণেই রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট হীরাটিকে নতুন করে কাটানোর জন্য আগ্রহী ছিলেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোহিনুর বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরা নয়। এর অবস্থান ৯০তম। ফলে টাওয়ার অব লন্ডনে ঘুরতে যাওয়া অনেক পর্যটককে এর আকৃতি দেখে অবাক হতে দেখা যায়। অনেকেই দাবি করেন, কোহিনুর হীরাটি ত্রয়োদশ শতকে ভারতের কোল্লুর খনিতে পাওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কবে- কোথায় এটি উত্তোলন করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নয়। অনেকেই আবার বিশ্বাস করেন, কোহিনুর কৃষ্ণকে নিয়ে রচিত ভগবদ পুরাণের সেই সিমন্তক মণি। মজার ব্যাপার হলো, থিও মেটক্যাফের প্রতিবেদনেও এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘কৃষ্ণের জীবদ্দশাতেই উত্তোলিত হয়েছিল কোহিনুর হীরা।’ হীরা যে এক মহামূল্যবান রত্ন- এ কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। বিশেষত হিন্দু ও শিখদের কাছে এটি অমূল্য রত্ন। কিন্তু মুঘল ও ইরানীদের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন। তারা হীরার থেকেও বেশি পছন্দ করত বৃহৎ, নিখুঁত, উজ্জ্বল রঙের পাথর। আর সেজন্যই কোহিনুর হীরাকে যে মুঘলদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে দাবি করা হয়, তা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেন না অনেক গবেষক। মুঘলদের রাজকোষে ছিল বহু ধরনের মূল্যবান ধন-সম্পদ। কোহিনুর হীরা সেগুলোরই একটি। একটা গল্প খুবই জনপ্রিয় যে, মোহাম্মদ শাহ রঙ্গিলা নাকি তার পাগড়ির ভেতর কোহিনুর লুকিয়ে রাখতেন। এ কথা জেনে যান নাদির শাহ। তিনি মোহাম্মদ শাহকে একটি প্রাচীন রীতির কথা মনে করিয়ে দেন- ‘দুই বাদশাহ পরস্পর দেখা হলে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে পাগড়ি বিনিময় করবেন।’ মোহাম্মদ শাহের বুঝতে বাকি রইল না, নাদির শাহ আসলে হীরাটি ছিনিয়ে নিতে চেয়েছেন। অথচ তৎকালীন পরিস্থিতিতে পাগড়ি বিনিময়ে অস্বীকৃতির মাধ্যমে নাদির শাহের বন্ধুত্বের আহ্বান ফিরিয়ে দেওয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তিনি বাধ্য হন পাগড়ি বিনিময় করতে। এভাবে পাগড়ি ও কোহিনুরের মালিক বনে যান নাদির শাহ। কিন্তু পারস্যের ইতিহাসবিদ মারভি বলেছেন, বাস্তবে মোহাম্মদ শাহের পক্ষে হীরাটি তার পাগড়িতে লুকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। সে সময়ে কোহিনুর ছিল সর্বকালের সবচেয়ে সুন্দর ও মূল্যবান হীরা। অনেক গবেষকের মতে, এর দ্যুতি এতটাই মুগ্ধকর ছিল যে, এটি মুঘল শাসক শাহজাহানের রুবি-পান্না ও মুক্তাখচিত ময়ূর সিংহাসনেও যুক্ত করা হয়েছিল। এ হীরাটি বহু বছর শাহজাহানের সিংহাসনে দীপ্তি ছড়িয়েছে। সিংহাসন তৈরির পর মুঘলরা এক শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষে ক্ষমতায় ছিল। পরে পারস্যের শাসক নাদির শাহ ১৭৩৯ সালে দিল্লিতে প্রবেশ করেন এবং লুট করেন দিল্লির ধন-সম্পদ। যেগুলো নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন ৭০০টি হাতি, ৪ হাজার উট এবং ১২ হাজার ঘোড়া। লুণ্ঠিত সম্পদের মধ্যে ছিল সিংহাসনটি। যার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ভারতবর্ষ ছাড়ে কোহিনুর। নাদির শাহ সিংহাসন থেকে কোহিনুর হীরাটি সরিয়ে একটি আর্মব্যান্ডে স্থাপন করেন। এরপর হাত বদল হয়ে হীরাটি যায় আফগানিস্তানে। শাসকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পার করে হীরাটি সেখানে ছিল ৭০ বছর। ১৮১৩ সাল নাগাদ এটি ভারতে ফিরে আসে এবং শিখ শাসক রঞ্জিত সিংয়ের দখলে চলে যায়। এরপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোহিনুর হীরা নামে একটি অমূল্য সম্পদের গুজব শুনতে পায় এবং এটি সংগ্রহ করার জন্য চেষ্টা করে। ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির কাছে হীরা ছিল ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রতীক। তিনি চেয়েছিলেন, ব্রিটেন হবে এ সম্পদের মালিক। ফরাসি রত্ন ব্যবসায়ী ও পর্যটক জন-ব্যাপ্টিস্ট ট্যাভারনিয়ার তথ্য অনুযায়ী, তিনি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত রত্নালঙ্কারের সংগ্রহশালা পরিদর্শনের অনুমতি পেয়েছিলেন। তার ভাষ্যমতে, সম্রাটের ভাস্কর হোর্তেনসিও বোর্গিও খুব বড় আকারের একটি হীরাকে ভুলবশত কেটে ফেলেছিলেন। এর ফলে হীরাটির আকৃতি নষ্ট এবং তা ছোট হয়ে যায়। কিন্তু তিনি ওই হীরাটিকে চিহ্নিত করেছিলেন ‘গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড’ হিসেবে- যেটা শাহজাহান হীরা ব্যবসায়ী মীর জুমলার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন। একটা সময় অনেকেই বিশ্বাস করতেন, গ্রেট মুঘল ডায়মন্ডই হয়তো কোহিনুর। কিন্তু বর্তমানে অনেক গবেষক একমত হয়েছেন যে, সেটা ছিল অরলভ হীরা। এটি বর্তমানে মস্কোর ক্রেমলিন জাদুঘরে দীপ্তি ছড়াচ্ছে। কোহিনুরের দীর্ঘ ইতিহাসে এটি অসংখ্যবার চুরি হয়েছে এবং স্থানান্তরিত হয়েছে। এর হাতবদলের ইতিহাস বড়ই বিচিত্র! বিশ্লেষকরা বলছেন, হীরাটি হলো ‘বিজয়ী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্যের প্রতীক’। তাই এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সবচেয়ে বিতর্কিত হীরার ইতিহাস চলতে থাকবে যুগের পর যুগ।

কলাম লেখক

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত