বাইডেনের ‘ভুয়া’ উপদেষ্টা

বিএনপির এ কেমন প্রতারণার রাজনীতি

প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের সব দেশই কম-বেশি ভয় পায়, সমীহ করে এবং এই দেশটির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য যে কোনো দেশের পাশাপাশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আগ্রহী থাকে। যুক্তরাষ্ট্র খুশি তো বিশ্ব খুশি। প্রভাবশালী এই দেশটির হস্তক্ষেপ কামনা করাও আমাদের জীবনাচরণে স্থান পেয়েছে। আর সেই দেশের প্রেসিডেন্ট আরো অনেক বেশি ক্ষমতাবান। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সহধর্মিণী হিলারি কিèনটনের ব্যক্তিগত বন্ধু হওয়ায় আমাদের দেশের একজন নোবেল বিজয়ী মাঝেমধ্যে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। তেমনি এক ব্যক্তিকে আবিষ্কার করেছে রাজপথের বিরোধীদল বিএনপি। তারা এক ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা সাজিয়ে নয়াপল্টনে বিএনপির প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে গেলেন ২৮ অক্টোবর। সেখানে তিনি বিএনপির নেতাদের শেখানো বুলি ইংরেজিতে উচ্চারণ করলেন। তার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় তিনি বাংলাদেশে র্যাবের বাইরে পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে জো বাইডেনকে প্রভাবিত করার মতো যোগ্যতা রাখেন। জো বাইডেনের উপদেষ্টা বাংলাদেশে আসবেন, সে খবর তো অন্তত বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার কথা। মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকেও জানানোর কথা। অথচ কোনো প্রকার যোগাযোগ না করে হঠাৎ করে বাইডেনের উপদেষ্টা বিএনপির দলীয় অফিসে গিয়ে হাজির হবেন, এটা তো রীতিমতো তাজ্জব ব্যাপার। মার্কিন দূতাবাসে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই নামে বাইডেনের কোনো উপদেষ্টা নেই। আর মার্কিন প্রেসিডেন্টের কোনো উপদেষ্টার ঢাকা আসার কোনো খবর সম্পর্কে তারা অবহিত নয়। ভুয়া পরিচয়দানকারী ব্যক্তি সেদিন বিএনপির দলীয় অফিস থেকে অজ্ঞাত স্থানে চলে গেলেন। বিএনপির অফিসে তার উপস্থিতি নিয়ে সারাদেশে হৈ চৈ পড়ে গেল। তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য কূটনৈতিক পাড়ার ব্যস্ততা বাড়ল। অবশেষে ওই ব্যক্তিকে গত রোববার দুপুরে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, আগের দিন ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তিনি সন্দেহজনক উপস্থিত হন। তিনি বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনে বিরোধীদের বাইডেন প্রশাসনের সমর্থন পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়ার খবর প্রকাশ হওয়ার একদিন পর, বাংলাদেশ ত্যাগ করার চেষ্টাকালে বিমানবন্দর থেকে তাকে প্রেপ্তার করা হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার তাকে মিয়া জাহিদুল ইসলাম আরেফি নামে শনাক্ত করে বলেন, ‘দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে পৌঁছলে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ডিএমপি’র গোয়েন্দা শাখায় নেওয়া হয়। ২৮ অক্টোবর বিকালে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দলের নেতা ইশরাক হোসেনের পাশে বসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় আরেফিকে। ওই ব্যক্তিকে বলতে শোনা গেছে যে তিনি ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক কমিটির সদস্য’ হিসেবে বাইডেনের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করছেন এবং তিনি বাংলাদেশে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন নিশ্চিত করতে বিরোধীদের মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমর্থনের আশ্বাস দেন বলেও জানা যায়। বিএনপি কার্যালয়ে তাকে ইংরেজিতে বলতে শোনা যায়, ‘আমি জাতীয় গণতান্ত্রিক কমিটি’র একজন সদস্য। আমাদের মধ্যে একটি উষ্ণ সংযোগ রয়েছে। জো বাইডেন এবং আমি দিনে ১০ থেকে ১৫ বার টেক্সট মেসেজ আদান-প্রদান করি।’ বিএনপির কিছু জুনিয়র নেতা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এবং ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এর আগে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস আরেফিকে এই বলে প্রত্যাখ্যান করে যে ‘এই ভদ্রলোক মার্কিন সরকারের পক্ষে কথা বলার কেউ নন এবং তিনি একজন বেসরকারি লোক।’ মার্কিন দূতাবাসের বক্তব্য প্রকাশের পর আরেফির বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘তিনি একজন প্রতারক।’ এদিকে, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ আরেফি’র মিথ্যা পরিচয় দেওয়াকে ‘বিএনপি’র প্রতারণা’ বলে অভিহিত করে বলেছেন, ‘আমাদের তথ্য অনুসারে তিনি একজন ইসরাইলি এজেন্ট। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা বলে দাবি করা মিয়া আরেফির বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুল ইউনিয়নের মানিকদিয়ার গ্রামে। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি বেলাল হোসেন নামে পরিচিত। তারা বাবার নাম রওশন মণ্ডল। প্রায় ৩৫ বছর ধরে বেলাল সপরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তারা সবাই তাকে বেলাল হোসেন নামেই চেনেন। তবে তিনি সপরিবারে আমেরিকায় থাকলেও গ্রামে তার অনেক আত্মীয় আছেন। এ বছর কোরবানির ঈদের পর গ্রামে এসেছিলেন। সলঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ জানান বিষয়টি জানার পর তিনি তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। গ্রামের বাড়িতে তার পরিবারের কেউ নেই। তবে গ্রামের লোকজন তাকে বেলাল হোসেন নামেই চেনেন। তার বাবা মৃত রওশন আলী আশির দশকে পাবনা জেলা শিক্ষা অফিসে চাকরি করতেন। মিয়া আরেফি ওরফে বেলালরা ছয় ভাই ও চার বোন ছিলেন। ৩৫ বছর আগে তারা সপরিবারে গ্রাম ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান। প্রশ্ন হচ্ছে- বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে এই ধরনের নাটক সাজিয়ে বিএনপি দেউলিয়াপনার জন্ম দিয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা নানা রকম গুজব ও ফেসবুকে ভুয়া ও অসম্ভব মিথ্যা বার্তা দিয়ে মানুষকে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্তি করছে। যদি ওই ভুয়া উপদেষ্টার আসল পরিচয় পাওয়া না যেত, তা হলে বাংলাদেশের রাজনীতি ওলট-পালট হয়ে যেতে পারত।