ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যুদ্ধের ডামাডোলে গুরুত্বহীন জলবায়ু ইস্যু!

অলোক আচার্য, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
যুদ্ধের ডামাডোলে গুরুত্বহীন জলবায়ু ইস্যু!

আগামী চলতি মাসেই দুবাইয়ে কপ এর ২৮তম সম্মেলন অ নুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এখানে বিশ্ব নেতারা বরাবরের মতোই জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে নানা প্রতিশ্রতি দিবেন। গত কয়েকটি কপ সম্মেলন থেকে এটাই অনুমান করা যায়। কিন্তু পদক্ষেপ কতটা কি নিতে পারবে সেটা নিয়েই সন্দেহ। পৃথিবীতে এখন যুদ্ধ চলছে গত কয়েক দশকের থেকেও বেশি মাত্রায়। এই যুদ্ধ বন্ধ করতেই এখন বিশ্ব নেতাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এর মধ্যে জলবায়ু যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এবং তা যুদ্ধের চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে তা ভুলতে বসেছি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার পক্ষ থেকে জানা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণতাকে প্রাক শিল্পোস্তরের ওপরে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে প্রতিশ্রুত জ্বালানি নীতিগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে। পৃথিবীতে এখনো অনেক উচ্চমাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে বলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়। সংস্থাটি বলছে, এখন পরিস্থিতি এমন যে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে অথবা ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি ফারেনহাইটে সীমিত রাখার প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের তুলনায় এ জ্বালানির চাহিদা ও ব্যবহার এখনো অনেক বেশি। আইইএ তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলছে, এক বছরের রেকর্ডভাঙা তাপমাত্রার পর এই ঝুঁকি জলবায়ু প্রভাবকে আরও খারাপ পরিস্থিতির নিরাপত্তাকেও ক্ষুণ্ন করবে। ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কার্বন নির্গমন অবস্থায় ফেরা সম্ভব, তবে খুব কঠিন। সংস্থাটি বলেছে, নীতিগত পরিবর্তন না হলে, এই শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা প্রায় ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। মানুষের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ এবং গ্রহণযোগ্য আবাসস্থল হিসেবে স্বীকৃত এই পৃথিবী। সবুজ শ্যামল এই ধরণীর বুকে কোটি কোটি প্রাণীর বাস। পৃথিবীর শুরু থেকেই মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ হারিয়েও গেছে। এর মধ্যে আমাদের পরিচিত ডাইনোসরের কথা উল্লেখযোগ্য হিসেবে বলা যায়।

ছোট বড় বহু প্রাণীর অস্তিত্বই হারিয়ে গেছে। আরো বহু প্রাণী সেই তালিকায় স্থান পেতে চলেছে। এভাবে হয়তো একদিন বিপন্ন হবে মানুষের অস্তিত্ব। এই চিন্তা থেকে মানুষ পৃথিবীর বাইরে কোনো গ্রহে বসবাসের উপযুক্ততা খুঁজে পেতে সংগ্রাম করছে। কিন্তু এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। শেষ পর্যন্ত কি হবে তা সময়ই বলবে। এখনো পৃথিবীতেই আশ্রয় খুঁজে নিতে হচ্ছে মানুষকে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এই হুমকি আরো বেড়েছে বহুগুণে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীতে কীটপতঙ্গ সংখ্যায় মানুষের অন্তত ১৭ গুণ বেশি। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে একশ’ বছরের মধ্যে তাদের ৬৫ শতাংশই বিলুপ্ত হতে পারে। ন্যাচার ক্লাইমেট চেইঞ্জ জার্নালে সম্প্রতি গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এতে অংশ নেয় নাসা ও একাধিক দেশের বিজ্ঞানী। গবেষণায় বলা হয়েছে, তাপমাত্রার ভারসাম্যহীনতার কারণে প্রাণীর জনসংখ্যা প্রভাবিত হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে ৩৮ প্রজাতির কীটপতঙ্গের ৬৫ শতাংশ বিলুপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে শীতল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বলা হচ্ছে, ফুল, ফল, সবজির ফলনে পতঙ্গের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তারা বিলুপ্ত হলে মানুষের জীবনধারণও হুমকির মুখে পড়বে। ফলে মানুষের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার প্রভাবজনিত বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতি বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়।

প্রকৃতি এবং প্রাণ ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। প্রকৃতি ধ্বংস হলে তা প্রাণের ধ্বংসও অনিবার্য। প্রকৃতির একটি উপাদানও বিনষ্ট হলে শৃঙ্খল নষ্ট হয়। যার প্রভাব থাকে সুদূরপ্রসারী। প্রকৃতি বলতে পৃথিবীতে সৃষ্ট প্রতিটি প্রাকৃতিক উপাদানকেই বোঝায়। যার ওপর ভর দিয়ে মানব সভ্যতা এগিয়েছে। আমাদের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা সবকিছুর জোগান পাই প্রকৃতি থেকে। মানুষ নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করেছে, এখন প্রকৃতি তার পাল্টা আচরণ করছে।

আমরা যা আশা করি না তেমন রুদ্র রূপ দেখতে হচ্ছে। প্রকৃতি নিজেই নিজের অবস্থান পাল্টাচ্ছে যা মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে। বছরের বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নানা রোগব্যাধি পৃথিবীকে গ্রাস করছে।

জাতিসংঘ বিজ্ঞানীদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মানুষের হাতে বিশ্ব উত্তপ্তকারী বিপজ্জনক গ্যাস নির্গমন অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষদিকে সমুদ্রের পানির উচ্চতা দুই মিটার পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগামী দশকগুলোতে বৈশ্বিক উষ্ণতা কীভাবে বিশ্বকে বদলে দেবে তা এই প্রতিবেদনে বিস্তারিত ফুটে উঠেছে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়াসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরো বেশি সামনে এনেছে। ২০৫০-এ বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়বে ৩ ডিগ্রি। বাংলাদেশে এখনই বেড়ে গেছে ২.৭৪ ডিগ্রি। অর্থাৎ প্রাণী ও উদ্ভিদকূলের সঙ্গে মানুষের অস্তিত্বও হুমকির মুখে। সে কারণেই মানুষ হন্যে হয়ে অন্য গ্রহে ছুটে চলেছে। কিন্তু আদৌ মানুষ কোনোদিন অন্য কোনো গ্রহে তাদের বাসযোগ্য ঠিকানা খুঁজে পাবে কি? এটি এখনো অমীমাংসিত প্রশ্ন।

প্রকৃতিকে আমরা যতই হালকাভাবে দেখি না কেন এটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এর ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন ছিল।

দীর্ঘদিনের এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড পরিবেশ পরিবর্তন করছে। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে। এই জলবায়ু পরিবর্তনই এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম কারণ। আমাদের বেঁচে থাকতে হলে প্রকৃতির রক্ষা করতে হবে। মানব সভ্যতার টেকসই নিরাপত্তা, খাদ্য শৃঙ্খলা রক্ষা করা, সুরক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ করতে হবে। প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো গাছপালা।

মানুষ তার নিজের কাজের জন্য, সভ্যতার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গাছ কেটেই চলেছে। যেখানে আমাদের কোটি কোটি গাছ লাগাতে হবে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য সেখানে আমরা সামান্য কারণেই গাছ কেটে সেখানে নির্মাণ করছি স্থাপনা। একটি গাছ কেবল মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, প্রকৃতির অন্যান্য বহু প্রাণীরও আবাসস্থল। পরিবেশের সবক’টি উপাদান পানি, বায়ু, মাটি এবং শব্দ এসব দূষণ ঘটছে মারাত্মকভাবে। যার ফলও হাতেনাতেই পাচ্ছে মানুষ। কারণ এটা নির্ভর করছে মানুষের চরিত্রের ওপর এবং এটা মনে করার কোনো কারণ নেই হঠাৎ মানুষ নিজেকে বদলে ফেলবে। মানুষ নদী দখল করবে না, পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করবে, বনভূমি উজাড় করে সেখানে কৃষিজমি করবে অথবা অট্টালিকা গড়বে। এখান থেকে বের হতে হলে মানুষকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে দ্রুত ঝুঁকতে হবে। সেই কাজ বিভিন্ন দেশই অব্যাহত রেখেছে, তবে সেই গতি হতে হবে আরো বেশি। পৃথিবীব্যাপীই জ্বালানি তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই চাহিদা ২০৪৫ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে আইইএ’র মত। সেফ এনার্জীতে ফিরতে দেশগুলোকে আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে।

সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের বাস্তুভিটা হারাবে। এসব আশ্রয়হীন মানুষ জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে শহরমুখী হবে। এর ফলে বহুমুখী সমস্যা তৈরি হবে। প্রকৃতির পরিবর্তন আমাদের খাদ্য শৃঙ্খল, অভ্যাস ও জীবনধারা প্রভৃতির পরিবর্তন করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে। প্রকৃতি সংরক্ষণ করতে হলে দরকার বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা। আজকের প্রকৃত মানুষের নির্মমতার শিকার। আর মানুষ এখন সেই কর্মকাণ্ডের ফল ভোগ করছে। যদি আমরা আমাদের অবস্থান পরিবর্তন না করি তাহলে ভবিষ্যতে এর ফলও আমাদেরই ভোগ করতে হবে। বহু উদ্ভিদ ও প্রাণীর সঙ্গে মানুষও একদিন এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে আর তার হাত থেকে আমরা কেউ বাঁচতে পারব না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত