উন্নয়ন প্রসারে পোশাক খাতকে শঙ্কামুক্ত রাখা জরুরি

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ ভিসানীতি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে কি না তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা ও গুঞ্জন চলেছে। ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, নতুন ভিসানীতি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখনই কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এর দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। যুক্তরাষ্ট্র যদিও ভিসানীতি বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ বায়ান্ন বছরে ঘটনাটি নজিরবিহীন। বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন ভিসানীতি বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতার নজির। অন্যদিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষক, স্থানীয় সরকার ও রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের অভাব থাকায় মার্কিন ভিসানীতি। রাজনীতিকদের এই ব্যর্থতার দায় বহন করার কথা বলছেন অনেকেই। ওদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি তৈরি পোশাক শিল্পের দুটি মূল গন্তব্যের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ভিসানীতি তাদের উদ্বেগের প্রতিফলন মাত্র। গত বছর, ওয়াশিংটন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছিল। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন আয়োজিত হাই-প্রোফাইল সামিট ফর ডেমোক্রেসির দুই সংস্করণেও ঢাকাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতেই ভিসা রোধ করা হয়েছে। আসলে যারা প্রকৃতপক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে তাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। কারণ মার্কিন সরকার অবশ্যই এই বিধি-নিষেধ আরোপের আগে যথাযথ ভিত্তি কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাংলাদেশ-আমেরিকান ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের বিষয়ে মার্কিন সরকারের কাছ থেকে আসা হাই-ভোল্টেজ ব্যস্ততা এবং যোগাযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এটা নিশ্চিত যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষার চেষ্টা না করে অন্তত নামমাত্র একটি সংকল্প নিয়েছে। তারা এখানে খুব বেশি খরচ করছে না। সহজ এবং ঝামেলাহীন পন্থা হিসেবে শুধু ভিসা নিষেধই আরোপ করেছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য যে তেমন আক্রমণাত্মক নয় তা স্পষ্ট। এরপরেও গণতন্ত্রের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকলে হয়তো তারা বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং বিচার বিভাগের ওপরও বিধি-নিষেধ দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নকারী এ রপ্তানি খাতটি যে সংকটের মুখোমুখি হয়েছে সেটা হলো অর্ডার বাতিল হওয়া। পোশাকের একটা অংশ, যেগুলোর মান ভালো, কেউ কেউ রপ্তানি করে দিচ্ছেন কম দামে। বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো যেটাকে নকল পণ্য রপ্তানি হিসেবে অবহিত করছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে নকল তৈরি পোশাক রপ্তানির আগের বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। সম্প্রতি এটা নিয়ে উদ্বেগও জানানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। বিষয়টি পোশাক খাতের জন্য যে মোটেই সুখকর নয়, সেটা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পোশাক শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ বরাবরই উদাসীন। তারই ধারাবাহিকতায় তাজরীন গার্মেন্ট, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মতো ঘটনা ঘটেছে। আর এসবের জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে এ খাতকে। তাই উচিত ছিল অতীতের ভুলগুলোকে শুধরে পোশাক শ্রমিকদের সাধারণ নিরাপত্তাটুকু নিশ্চিত করে এ খাতকে শঙ্কামুক্ত রাখা। কিন্তু আদৌও কি নিরাপত্তা ঝুঁকি ইস্যুতে অগ্রগতি সাধন হয়েছে? হলেও কতটুকু হয়েছে? সেটা এখন ভেবে দেখার বিষয়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির তথ্য অনুযায়ী, দেশে রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানায় গত কয়েক বছরে অগ্নি দুর্ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এছাড়া দেশের মোট পোশাক কারখানাগুলোর মধ্যে বর্তমানে ৮৫৬টি কারখানা রয়েছে যেখানে শ্রমিকদের ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। কোনো রকম তদারকি ছাড়াই তারা উৎপাদন ও রপ্তানি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দিনে দিনে মনিটরিংয়ের বাইরে থাকা কারখানার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে মোট কারখানার ২২-২৩ শতাংশ মনিটরিংয়ের বাইরে এবং দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ভবিষ্যতে এটা বেড়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। অথচ এ ব্যাপারে না আছে কর্তৃপক্ষের কোনো তৎপরতা না আছে সরকারি কঠোর নির্দেশনা বা নির্দেশনা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে পোশাক খাতে কাজ করছেন ৩২ লাখ শ্রমিক। অথচ সংশ্লিষ্টদের কাছে এ বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীকে কোনো কারণ ছাড়াই বেতন-বোনাসসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করাই যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব পোশাক শ্রমিকের হাড়ভাঙা খাটুনি আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পরিশ্রমে ব্যবসায়ী-মালিকরা মোটা অঙ্কের মুনাফা ঘরে তুলছে, দেশের অর্থনীতিতে সুদিন ফিরে এসেছে, উন্নয়নের সবুজসংকেত দেখতে পাচ্ছে, অথচ তাদের ন্যায্য মজুরি আর বকেয়া বেতন-বোনাস দিতেই যেন যত গড়িমসি শুরু হয়। এ বিষয়ে সমাধান চাইতে গেলেই যেন সংশ্লিষ্টরা দেখেও না দেখার ভান করে, বুঝেও না বোঝার ভণিতা শুরু হয়। অবহেলা আর চরম উদাসীনতাই যেন এ হতভাগ্য শ্রমিকদের একমাত্র প্রাপ্য। অনেক সময় কারখানাগুলোয় শ্রমিকদের দিয়ে ওভার টাইম কাজ করালেও এর বিনিময়ে তাদের কোনো অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করা হয় না। এছাড়া নিম্ন মজুরি হার আর কম বেতন-ভাতার জন্য শ্রমিকদের অসন্তোষ তো আছেই। ন্যায্য মজুরি আর নিয়মিত বেতন-বোনাসের জন্য বছরের পর বছর আন্দোলন চালিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত হয়নি কোনো স্থায়ী সমাধান। বিলসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়েও অনেক কম। অথচ বাংলাদেশে যে হারে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে এ মজুরি নিতান্তই অপ্রতুল।