ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নজরুলসংগীত কি পণ্য?

করিম হাসান খান
নজরুলসংগীত কি পণ্য?

ইজ মিউজিক এ কমোডিটি? ইহা তাই- অতি সাধারণ প্রশ্ন এবং স্বাভাবিক উত্তর। কীভাবে? পণ্যের যেমন উৎপাদন থেকে শুরু করে তা ক্রেতা পর্যায়ে সরবরাহ তথা বাজারজাত করার একটি প্রক্রিয়া রয়েছে, সঙ্গে শ্রমিক, কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ট কাজে দক্ষ জনবল থাকে, তেমনি সংগীতের ক্ষেত্রেও শিল্পী, রেকর্ডিং হাউস, রেকর্ড (এলপি, সিডি, ক্যাসেট) ইত্যাদি এবং ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় করার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তা বাজারজাতকরণ। এভাবেই সংগীতও ক্রেতাদের কাছে এক পর্যায়ে পণ্য রূপে পরিগণিত হয়। সংগীতনির্ভর অনেক প্রতিষ্ঠানের নাম আমরা জানি যারা যুগ যুগ ধরে বিশ্বজুড়ে সফলভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, যেমন- ইএমআই, এইচএমবি, মেগাফোন, কলাম্বিয়া, হিন্দুস্তান, টুইন, পাইওনিয়ার, সেনোলা ইত্যাদি। মূলত রেডিও কার্যক্রম শুরু হওয়ার প্রারম্ভে গ্রামোফোন ছিল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। ১৯২৮ সনের আগে পর্যন্ত নজরুল কোনো গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দেননি। অবশ্য তারও আগে ১৯২৫ সালে এইচএমভি থেকে নজরুলের গান ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’ গানটি হরেন্দ্র নাথ দত্তের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়, রেকর্ড নম্বর এইচএমভিপি ৬৯৪৫; উল্লেখ্য এ গানটি নজরুলের প্রথম রেকর্ড। এক পর্যায়ে সম্ভবত ১৯৩০ সালে নজরুল গীতিকার, সুরকার এবং পরিচালক হিসেবে এইচএমভিতে যোগ দেন চুক্তিভিত্তিক। তারপর মেগাফোন, কলাম্বিয়া, টুইন, হিন্দুস্তান রেকর্ডস, পাইওনিয়ার, সেনোলা রেকর্ড কোম্পানিগুলোতে পর্যায়ক্রমে কাজ করেন। এরই মধ্যে রেডিও কার্যক্রম শুরু হলে দ্রুত শ্রোতা সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ব্যাপক আকারে। নজরুল অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতায় নানা অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন গীতিকার, সুরকার, পরিচালক ও সঞ্চালক হিসেবে। নজরুল সে সময় অল ইন্ডিয়া রেডিও ঢাকা কেন্দ্রেও কিছু কিছু অনুষ্ঠানে অংশ নেন যা চলমান ছিল কবি অসুস্থ হবার পূর্ব মুহূর্ত অবধি। ১৯৪২ সনের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ কবি যতদিন সুস্থ ছিলেন- তার গানের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখায় সদা সচেষ্ট ছিলেন বলেই তার গান সমকালীন বা তারও আগের অন্যান্য গানকে পেছনে ফেলে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসতে সক্ষম হয়। সে সময়ে বাংলা গানের সব ধারাকে পাশ কাটিয়ে নজরুলের গান শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে এক চমক হিসেবে। মূলত বাংলা গানের আধুনিক রূপায়নে নজরুল ছিলেন রূপকার। তাইতো সে সময়ের সব ধারার তারকা শিল্পী যেমন আঙুর বালা, কানন বালা, ইন্দু বালা, জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, কাশেম মল্লিক থেকে শুরু করে আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, সতীনাথ, জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং শেষের দিকে মুহাম্মদ রফি, অনুপ জালোটা, মানবেন্দ্র, শ্যামল মিত্রের মতো শিল্পীবৃন্দ নজরুলের গান করেছেন আগ্রহ ভরে। নজরুলের গানে স্বকীয়তা, আধুনিকতা এবং নানামুখী বিষয়ের সমন্বয় এবং জনপ্রিয়তা বিবেচনায় উজ্জ্বল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা চিন্তা করে সে সময়ের নামিদামি ও প্রতিষ্ঠিত গ্রামোফোন কোম্পানিগুলো নজরুলের দ্বারস্থ হয় এবং কোম্পানিগুলো শতভাগ ব্যবসা সফল হয়। একটি কথা কোনো কোনো মহল অশুভ উদ্দেশ্যে বলে থাকে যে নজরুল অভাব, অনটন, অর্থসংকটের কারণে গ্রামোফোন কোম্পানিতে চাকরি করেন এবং ফরমায়েশি গান রচনা করেন- কথাটি সঠিক নয়, নজরুলের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কারণে একটি মহল কবিকে ছোট করার লক্ষ্যে অপপ্রচার চালায় যা হীনমন্যতা ও পরশ্রীকাতরতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এ প্রবণতা এখনও বিদ্যমান। অন্তত একটি গানের উদাহরণ কেউ দিতে সক্ষম হবে না যে গানটি কবি গ্রামোফোন কোম্পানির ফরমায়েশে লিখেছেন বা সুর করেছেন। তবে একথা ঠিক যে গ্রামোফোন কোম্পানি কখনো কখনো চুক্তি লঙ্ঘন করে কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছে যা কবি তাৎক্ষণিক আপত্তি জানিয়েছেন।

তারপরও কোম্পানিগুলোর কিছু কিছু স্বেচ্ছাচারিতার কথা শোনা যায়। সেই স্বেচ্ছাচারিতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কবি অসুস্থ হওয়ার পর। তার প্রধান কারণ ছিল নজরুলের গানের বিপুল জনপ্রিয়তা। এই জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে নিজে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার একটি অসুস্থ প্রবণতা ও প্রতিযোগিতা দেখা দেয় কলকাতাজুড়ে। অনেক তারকা শিল্পীও খেই হারিয়ে এই অসুস্থ প্রবণতায় গা ভাসিয়ে দেন যা অডিও কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিক সম্ভাবনার শতভাগ সদ্ব্যবহার করে। পলিডোর, এইচএমভির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো মুহাম্মদ রফি, অনুপ জালোটা, মানবেন্দ্র, অনুপ ঘোষাল, পূরবী দত্ত, ইন্দ্রানী সেনের মতো তারকা শিল্পীদের কাজে লাগিয়ে রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্যিক সুবিধা লাভ করে। তারা সবাই নিঃসন্দেহে তারকা শিল্পী তবে একজনও প্রকৃত নজরুল সংগীতের শিল্পী নন। ওই যে বললাম রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্যিক সুবিধা, এ ক্ষেত্রে পণ্য এবং ব্রান্ড হিসেবে নজরুল সংগীত শতভাগ সফল হলেও গান হিসেবে নজরুল সংগীতে রেখে গেছেন আকাশ সমান বিতর্ক। আর কারো কারো কাছে তারা আজো নজরুল সংগীতের ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর।

লেখক : শিল্পী, সংগঠক ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত