হে সমাজ, কিছু মানুষ দাও...

আরিফ আনজুম

প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আমরা সবাই কম-বেশি সমাজকে মনে-প্রাণে ভালোবাসি, কারণ সেখানে কিছু মানুষ বাস করে। আমরা ‘মানুষ’কে শ্রদ্ধা করি আর মানুষ বিশ্লেষণে একটু ভিন্ন কথা বলব আজ আমি। সমাজে কেউ ভালো মানুষ, কেউ খারাপ মানুষ আছে! দুঃখিত, আমি দুটো গুণের একটিকেও মানতে অপারগ। ভালো মানুষ বলতে কিছু নেই, খারাপ মানুষ বলতেও কিছু নেই। বরং যার মান, হুঁশ, বিবেক বোধ আছে তাকেই শুধু মানুষ বলব আর যার নেই তাকে প্রাণী বলব। তার মানে, মানুষ তারাই যাদের দায়বদ্ধতা আছে সমাজের প্রতি এবং তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের প্রতি। লোভী এবং শুধুমাত্র নিজ স্বার্থ আদায়ের জন্য মরিয়া প্রাণীদের আমি আত্মকেন্দ্রিক প্রাণীই বলব। তার সঙ্গে আরেকটি অর্থাৎ মন্দ গুণ যার মধ্যে আছে তাকে বলব হিংস্র প্রাণী। যার অহঙ্কার করার মতো কিছু নেই, অথচ সে অহঙ্কারী এমন আরো একটি কুৎসিত গুণ যার মাঝে থাকে সে তো আরো বেশি নিকৃষ্ট প্রাণী। আর প্রতিনিধি দাবিকৃত যে প্রাণী তার ওপর অর্পিত ধন, মাল তার অধীন ব্যক্তিদের প্রতি সমানভাবে বণ্টন না করে পক্ষপাতিত্ব করে, সে তো হিংস্র, নিকৃষ্ট এবং স্বার্থপর। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত চিন্তা। কারো খারাপ লাগলে, সেটাও তার একান্ত ব্যক্তিগত হোক। তবে আমার চাওয়া আছে এবং থাকবে যে, সে প্রাণীরা মানুষ হোক।

সমাজের কিছু প্রাণী আছে যারা কেবল নিজের চিন্তা করতে করতে খেয়ে, পরে মরে যায়। তারা তো প্রাণীই। যেমন, চতুষ্পদ প্রাণী। যখন হাল চাষ করতে প্রয়োজন নেই, তখনো তো তারা তাদের খাওয়া বন্ধ করবে না। তারা খাবে এবং খেতেই থাকবে। খেয়ে-টেয়ে তাদের মালিকের জন্য তাদের কাজ করতে হবে এমন চিন্তা চতুষ্পদ প্রাণী করে না। একমাত্র মানুষই করে। সুতরাং যারা শুধু নিজের দিকটাই এভাবে বোঝে তাদের সঙ্গে চতুষ্পদ প্রাণীদের অতিশয় সুন্দর মিল! তাদের একাত্মতার বহিঃপ্রকাশ! তারা একে অপরের আত্মার আত্মীয়! সমাজের কিছু প্রাণী আছে যারা অন্যের অনেক কিছুকে নিজের করে পেতে চায়। তারা কখনো হালাল-হারামের ধার ধারে না। অন্যের জমির আল কেটে হোক, কিংবা নিজের জমিতে জল সেচ দিতে অন্যের খাল কেটে হোক, কুমির না আনলেও নিজের স্বার্থ হাছিলে ব্যস্ত তারা। তারা লোভী, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক। এমন লোভী-স্বার্থপর প্রাণীরা সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষের তরল ময়লাকে এত বেশি ভালোবাসে? তাদের রুচিবোধ দেখে কষ্ট হয়, আফসোস হয়! এমন কি তারা স্বার্থের জন্য নিজের প্রিয় মানুষকেও বিতাড়িত করার ভয় দেখাতে পারে, যাতে সে কারো কাছে সত্যকে প্রকাশ না করে। কারণ সত্য প্রকাশ হলে স্বার্থপর প্রাণীদের স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটবে তারা জানে। সমাজের গরিব শ্রেণির মানুষজন এমন কিছু লোভী অর্থশালীদের ক্ষেতে, খামারে কাজ না করে বাঁচতে পারলেও হয়তো স্বচ্ছতায় চলতে পারে না, কিন্তু এই গরিবরাই তো প্রকৃত ত্যাগী।

তাদের শ্রম ছাড়া সেই লোভী প্রাণীরা চলতে পারে না কখনো। গরিবরা যদি কাজ না করে তো খেতে পারে না, কিন্তু সে গরিব যদি অর্থবান প্রাণীদের ঘরে কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেই বসে, তবে অবশ্যই সে সব প্রাণীদের গরিবের পায়ে এসে পড়তে হবে। অথচ, যখন লোভী বিত্তশালী প্রাণীর ঘরের পাশে রোগে পড়ে সে গরিব মানুষটি সারারাত আর্তনাদ করে, সে গরিবকে দুই টাকার সাহায্য দেওয়ার মতো, তাকে ওষুধ কিনে দেয়ার মতো বিত্তবান প্রাণীরা এগিয়ে আসে না।

হয়তো আরেক গরিব মানুষ তার সমগোত্রীয় ভাইয়ের কষ্ট, আর্তনাদ অনুধাবন করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, ওষুধ কিনে দেয়। এই গরিবকে স্যালুট, তার মধ্যে মানবতাবোধ আছে, বিবেকবোধ আছে, যা কখনো টাকায় কিনতে পাওয়া যায় না। সে-ই সমাজের প্রকৃত মানুষ।

সমাজে এমন প্রাণীরও অভাব নেই যারা অর্থ দিয়ে মেধাকেও কিনতে চায়। ‘জ্ঞানীর হাত ধরা যায়, মূর্খের মুখ ধরা যায় না’ এমন সত্যটা সেই মূর্খরা জানে না, বোঝে না বলেই শিক্ষার মূল্যায়ন তাদের দ্বারা সম্ভব হয় না।

খোঁড়াযুক্তিতে আর অর্থের জোরে তাদের মুখ খুলে যায়। সাময়িক জয়ে মানুষের সামনে তারা হয়তো একাই হাসে, কিন্তু তাদের মূর্খতার জ্বালা-যন্ত্রণা সেই মূর্খ এবং শিক্ষিত-দুপক্ষই অনুধাবন করতে পারে। সমাজ আমার আশ্রয়।

সে সমাজের প্রতি আমার ছোট্ট একটা দাবি আছে- ‘হে সমাজ, কিছু মানুষ দাও...।’

লেখক : সহকারী শিক্ষক,

আমতলী মডেল উচ্চ বিদ্যালয় শিবগঞ্জ, বগুড়া।