১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় জেলহত্যা ও গ্রেনেড হামলা

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাক্তন উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কোনো সাধারণ অভ্যুত্থানের ঘটনা ছিল না। এটি ছিল জাতীয় চেতনাকে ধ্বংস করা বা দেশকে পুনরায় পিছিয়ে দেওয়ার একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্তের অংশ। এই একই চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় সংঘঠিত হয় ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ড। এসব হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন বা কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। পরাজিত শক্তি বাঙালি জাতির মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেওয়ার সুগভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবেই এসব হত্যাকাণ্ড ঘটায়। পরাজিত শক্তি বলতে আমি শুধু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের যারা সরাসরি বিরোধীতা করেছিল বা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল, তাদের বুঝাচ্ছি না। ১৯৪৮ সালেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তান নামক অদ্ভুত রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ বা বাঙালির অধিকার অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই আমাদের মাতৃভাষার ওপর আঘাত হানে। পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু বাঙালিদের ভাষা বাদ দিয়ে তারা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন বাঙালিরা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। একে একে অর্থনৈতিক, সামাজিক বৈষম্যগুলো সাধারণ মানুষের নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, পরবর্তীতে ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ- এই ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে ঘটে যেতে থাকে। বাঙালির প্রতিটি আন্দোলনেই কিছু বাঙালি বিরোধীতা করে। বাঙালিরা যাতে কখনোই তাদের ন্যায্য অধিকার ভোগ করতে না পারে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সেই চেষ্টাই করেছে।

বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করি না। মুক্তিযুদ্ধ বলি বা অন্য যে কোনো আন্দোলনের কথাই বলি না কেনো, আমরা কখনোই শতভাগ ঐক্যবদ্ধ ছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও কিছু মানুষ এর বিরোধীতা করেছে। বঙ্গবন্ধু যখন ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন, তখন অনেকেই এর বিরোধীতা করেছে। ছয় দফার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত ’৭০-এর নির্বাচনে ২৩.৭৪ শতাংশ বাঙালি ভোটার নৌকা মার্কার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। যখন রেডিও-টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করা হয়, তখনও বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার পক্ষে ছিল। ১০ জন বুদ্ধিজীবী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন এবং ৪০ জন বুদ্ধিজীবী এর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। ১৯৫৪ সালের যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচনের সময় থেকেই যারা এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তবুদ্ধির কথা বলতেন, যারা প্রগতির কথা বলতেন বা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার স্বপ্ন দেখতেন, তাদের ভারতের চর বা দালাল বলা হতো। অপবাদ দেয়া হতো, ভারতীয় চরেরা এ দেশে ইসলামকে ধ্বংস করার চক্রান্ত করছে। তারা পাকিস্তানি শাসকদের যে কোনো কাজকেই ইসলামের সঙ্গে যুক্ত করে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করত। পুরো পাকিস্তান আমলজুড়ে এই অবস্থা বিরাজ করে। তারা শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধীতা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি। ১৯৭১ সালে এসে তারা সরাসরি পাকিস্তানি দখলদার সামরিক জান্তার পক্ষে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। রাজাকার-আলবদর বাহিনী তৈরি করে তারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করে। এদের অনেকেই পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর মনে করা হয়েছিল এই পরাজিত গোষ্ঠী হয়তো তাদের ভুল বুঝতে পেরে দেশ গঠনে অংশ নেবে। কিন্তু তারা তা না করে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশেও তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে এই গোষ্ঠীটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সাল থেকে আমাদের এই দেশে যে সব প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ছিল, যারা বাঙালি অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করার জন্য সব সময় সচেষ্ট ছিল তারা ক্ষমতাসীন হয়। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক চেতনা এবং মূল্যবোধের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ক্ষমতাসীন হয়ে পুরো চিত্রটি পাল্টে দেয়। তারা আবারো পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশ পরিচালনা করতে শুরু করে। রাতারাতি ‘বাংলাদেশ বেতার’ হয়ে যায় ‘রেডিও বাংলাদেশ’। ‘জয় বাংলার’ বদলে চলে আসে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য সচিব রাজাকার বাহিনীর সৃষ্টিকর্তা রাওফরমান আলীর ঘনিষ্ট সহচর শফিউল আলম হন কেবিনেট সচিব। আইয়ুব ইয়াহিয়ার প্রিয় ব্যক্তি কাজী আনোয়ারুল হক হলেন খুনি মোস্তাকের উপদেষ্টা। জেনারেল ওসমানী হলেন উপদেষ্টা, মাওলানা ভাসানীও খোন্দকার মোশতাককে অভিনন্দন জানালেন। ’৭০-এর দশকে পুরো দুনিয়ায় বিভিন্ন দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটছিল। তখন বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক ব্লক এবং পুঁজিবাদী শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। যে কারণে বিভিন্ন দেশে প্রায়শই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটত। কিন্তু সেসব সামরিক অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনককে হত্যার মাধ্যমে শুধু রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মূল্যবোধের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে নবীন দেশটি আমরা লাভ করেছিলাম, তাকে আবারো পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তারা বাংলাদেশের ছদ্মাবরণে পূর্ব পাকিস্তান কায়েম করে। পাকিস্তানি চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যার কবর রচিত হয়েছিল, তা আবারো ফিরিয়ে আনা হলো। জামায়াত নেতা গোলাম আজম জেদ্দা থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে উল্লসিত হয়ে নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী প্রকাশ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তারা এই দেশটিকে মুসলিম বাংলা করার চেষ্টায়রত হয়। তারা বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণার দাবি উত্থাপন করতে থাকে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক পার্টি গড়ে তোলা হলো।

যারা মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজনীতি থেকে কার্যত নির্বাসিত হয়েছিল, তাদের পুনরায় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করা হলো। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু করেছিলেন। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সমর্থনে খুন, ধর্ষণ বা অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধে নিজেদের যুক্ত করেছিল, তাদের বিচারের কাজ শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সেই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। যারা শুধু বিরোধীতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে, কোনো ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেনি, তাদের মাফ করে দেয়া হয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত উদার মনের একজন মানুষ। তিনি ভেবেছিলেন, এদের ক্ষমা করে দিলে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে এবং দেশের উন্নয়নে নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে পারবে। কিন্তু কথায় বলে, ‘কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না।’ বঙ্গবন্ধুর উদারতাকে এরা মূল্যায়ন না করে বরং তার বিরোধিতা করতে থাকে। দেশে বহুমুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্য অনধিক ১০০ জন অংশগ্রহণ করেন। আর পাকিস্তানি বন্দিশালা থেকে ফিরে আসে প্রায় ১ হাজার ১০০ বাঙালি সেনা অফিসার। পাকিস্তান থেকে যেসব বাঙালি সেনা অফিসার ফিরে আসেন, আমি বলি না তাদের সবাই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তারা বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে বর্বরতা চালিয়েছে, তা প্রত্যক্ষ করতে পারেননি। ফলে তারা সেই ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন না। ফলে তারা বুঝতে পারেননি স্বাধীনতার জন্য আমরা কী মূল্যটাই না দিয়েছি। সেনাবাহিনীর ভেতরেও পাকিস্তান ফেরত এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনা কর্মকর্তাদের মাঝে এক ধরনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। স্থানীয়ভাবে কিছু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও তৈরি হলো। জাসদ নামক একটি উগ্রপন্থি রাজনৈতিক দল তৈরি হলো। তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলতে শুরু করে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের লেশমাত্র তাদের মধ্যে ছিল না। জাসদের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জলিলের পরিণতি দিয়ে প্রমাণিত হয়, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বলে তাদের মাঝে কিছুই ছিল না। মেজর জলিল (অব.) মৃত্যুর আগে খেলাফত মজলিশে যোগদান করেন এবং পাকিস্তানে গিয়ে মারা যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু যে জামায়াত-আলবদররাই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তা নয়, যারা চিনাপন্থি কমিউনিস্ট পার্টির কোনো কোনোটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। তাদের এই বিরোধিতা মুক্তিযুদ্ধের পরও অব্যাহত থাকে। ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয় বিজয় দিবস পালনের সময় সিরাজ শিকদার এবং তার দল বিজয় দিবসকে ‘কালো দিবস’ ঘোষণা করে ঢাকা শহরে হরতালের ডাক দেয়। মওলানা ভাসানী তাদের সেই ঘোষণাকে সমর্থন জানায়। স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট এই রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সব মিলিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি ও জাসদের গণবাহিনী একের পর এক থানা লুট ও দখল করতে থাকে। রক্ষীবাহিনীর সাথে বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। হরতাল, ব্যাপক বোমা হামলা, রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, সরকারি স্থাপনায় হামলা, পাটের গুদামে আগুন ইত্যাদি তৎপরতা ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সারা দেশে এক ধরনের থমথমে অবস্থা চলতে থাকে। সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা চলতে থাকে। কারণ, জুনিয়র কয়েকজন অফিসার গিয়ে বঙ্গভবন দখল করে। তারা অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলকারী খোন্দকার মোশতাককে দিয়ে নানা ধরনের অন্যায় কাজ করাচ্ছিল। সামরিক বাহিনীর মধ্য থেকে কিছু অফিসার যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, তারা সামরিক বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকেন। যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল বা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল, তাদের মনে ভয় ঢুকে যায়, যদি সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরে আসে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি আবার যদি ক্ষমতাসীন হয়; তাহলে তাদের বিপদ হতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সেনাবাহিনীতে যদি শৃঙ্খলা ফিরে আসে, সংবিধান যদি পুনঃস্থাপিত হয় এবং জাতীয় সংসদ কার্যকর হয় তাহলে সংসদের নেতৃত্বে কারা আসবে এসব প্রশ্ন দেখা দেয়। অভ্যুত্থানকারীরা বুঝতে পারে, জেলখানায় বন্দি চার জাতীয় নেতা বেরিয়ে আসবেন এবং তারাই জাতীয় সংসদ ও সরকারের নেতৃত্ব দেবেন। এই চার জাতীয় নেতা সম্পর্কে তাদের ভীতি ছিল। কারণ, নানাভাবে চেষ্টা করে, চাপ দিয়ে এমন কী প্রলোভন দেখিয়েও এই চার নেতাকে তারা সরকারে নিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এই চার নেতা ৯ মাস যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কাজেই তাদের নেতৃত্বের গুণাবলী এবং ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অভ্যুত্থানকারীরা সচেতন ছিল। বঙ্গবন্ধুর কোনো কোনো অনুসারি অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে হাত মেলালেও এই চার জাতীয় নেতা ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। কাজেই অভ্যুত্থানকারীরা তাদের বাঁচিয়ে রাখার সাহস করেনি। তারা বুঝতে পেরেছিল এই চার নেতাকে বাঁচিয়ে রাখা হলে একসময় এরা বিপদের কারণ হতে পারে। এছাড়া এদের জনপ্রিয়তাও ছিল আকাশচুম্বি। অভ্যুত্থানকারীরা বঙ্গভবনে বসেই এই চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড বিরল। জেলখানার কোনো জাতীয় নেতাকে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসে নজীরবিহীন। জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যার ঘটনার সঙ্গে আমি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মিল খুঁজে পাই। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের স্থানীয় দোসররা যখন দেখল স্বাধীনতা কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না, তখন তারা জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গভবনে অবস্থানকারী বিপথগামী সেনা কর্মকর্তারা যখন দেখল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির পাল্টা অভ্যুত্থান ঠেকানো যাচ্ছে না, তখন তারা জেলখানায় বন্দি চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে এবং নির্মমভাবে তা বাস্তবায়ন করে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য খোন্দকার মোশতাকের অনুমোদন ছিল। হত্যাকারীরা জেলখানায় যাওয়ার পর জেলার তাদের বাধা দিয়েছিলেন। পরে জেলার মোস্তাকের সঙ্গে কথা বললে তিনি (মোস্তাক) বলেন, তারা যা করতে চায়, তা করতে দিন। কোনো ধরনের বাধা দেবেন না। জেল হত্যাকাণ্ড কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। এটি ছিল একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্রেরই অংশ। উল্লেখ্য, মেজর ফারুক ও রশিদ দুই মাস আগে পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হলে কারাগারে বন্দি চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনায় খোন্দকার মোশতাকের সম্মতি ছিল। তখন বঙ্গভবনেই থাকতেন ফারুক, রশিদরা। এমনকি রশিদ রাষ্ট্রপতির মর্যাদার গাড়িটিও ব্যবহার করতেন। ৩ নভেম্বর ভোর রাতে ডিআইজি প্রিজন বঙ্গভবনে ফোন করলে রশিদই ফোন ধরেন। রশিদ খন্দকার মোশতাকের কাছে ফোনের রিসিভার হস্তান্তর করেন। মোশতাক ফোন ধরে বেশ কিছুক্ষণ শান্তভাবে শুনে বললেন হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। উপায়ন্তর না দেখে মোসলেউদ্দিন ও তার দলকে আর বাধা দেয়ার চেষ্টা করেননি।

তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক সেলেই ছিলেন। পাশের অন্য সেলটিতে ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান। তাদের একটি সেলে জড়ো করে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনজন সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। অবশেষে রক্তক্ষরণে মারা যান তাজউদ্দীন আহামদ। অভ্যুত্থানকারীরা এই চার নেতাকে বাঁচিয়ে রাখাটাকে নিরাপদ মনে করেনি। তাই তাদের হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা আর জেলহত্যা একই সূত্রে গাথা। জেল হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে হত্যার রাজনীতি শেষ হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার অনিবার্য ধারাবাহিকতা হচ্ছে- একই বছরের ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ড। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে যে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তীতেও অব্যাহত রয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর বোমা হামলাসহ বিভিন্ন সময় তাকে হত্যার যেসব চেষ্টা চালানো হয়েছে, তা সেই ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা বলেই আমি মনে করি। এমন কী, এক-এগারোর সময় দৃশ্যত দুই নেত্রীকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার যে প্রচেষ্টা (আসলে শেখ হাসিনাকেই শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল) আমরা লক্ষ্য করি তাও সেই একই হত্যা ষড়যন্ত্রেরই ধারাবাহিকতা। ১৫ আগস্ট যারা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল, তাদেরই আত্মীয়স্বজন ব্রিগেডিয়ার বারি, বিগ্রেডিয়ার আমিন পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করে নিয়েছিলেন এক-এগারোর পর। এই মহলটি এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। আজকে আমরা যাদের জঙ্গি বলি এরা কারা? বলা যেতে পারে এদের তো ১৯৭১ সালে বা ১৯৭৫ সালে জন্ম হয়নি। কিন্তু আপনি বিশ্লেষণ করলে দেখবেন, এরা সেই পাকিস্তানি ভাবধারা অনুসরণ করে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। আমি এটা জোর দিয়ে বলতে পারি, বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারার মানুষের অভাব নেই। বর্তমানে যে জঙ্গিবাদের উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে এদের টার্গেটও কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাজার বছরের শ্বাশত বাঙালির চেতনা এবং মূল্যবোধ ধারণ করে চলেছেন।

তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারক এবং গণতন্ত্রের মানসকন্যা। এসব কারণে জঙ্গিরা শেখ হাসিনাকেই বারবার টার্গেট করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর বারবারই আঘাত এসেছে। এই আঘাত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আরো শানিত করেছে। যে কোনো প্রতিবন্ধকতা এলেই জাতীয়তা বোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শানিত হয়। কারণ, সব কিছু স্বাভাবিকভাবে চললে সেখানে চেতনা ততটা কাজ করে না। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা এলেই চেতনাবোধ জাগ্রত হয়। বারবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর আঘাত এসেছে বলেই আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ক্রমশ শানিত হচ্ছে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের প্রসঙ্গটি। এই বিচারকার্য শুরু হলে নানামুখী ষড়যন্ত্র আরম্ভ হয়। বিচার বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির উদ্যোগে সৃষ্টি হয় গণজাগরণ মঞ্চ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা করার জন্যই গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টি হয়। এটা হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়নি। এভাবে যখনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর আঘাত এসেছে, তখনই মানুষ নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কাজেই বলা যায়, যতবারই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর আঘাত আসবে ততই এই চেতনা শানিত হবে।