খাদ্য যখন যুদ্ধের অস্ত্র হয়

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আরব-ইসরাইলের মধ্যে ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধ শুরু, সেটা চলছে এখনো। পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭৩ সালে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আরব দেশগুলোর সঙ্গে আর কোনো যুদ্ধ না হলেও ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধ হয়নি। যদিও সংঘাত বন্ধে শান্তির ফরমুলা হিসেবে বিভিন্ন সময় দুই রাষ্ট্র সমাধানের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সেটা আর বাস্তবে রূপ নেয়নি। ফিলিস্তিন এবং ইসরাইল দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের সমাধান প্রথম এসেছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের মাধ্যমে। সে সময় বলা হয়, ইসরাইল হবে ইহুদিদের জন্য এবং ফিলিস্তিন আরবদের জন্য। তবে ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। যেটা আরবরা মানেনি। এর ধারাবাহিকতাতেই হয় প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। কিন্তু একটা সময়ে এসে ঠিকই ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন উভয়পক্ষই দুই রাষ্ট্র সমাধানে ঐক্যমত হয়। কিন্তু সেটা কীভাবে হলো? এবং পরে কেন আবার ব্যর্থও হলো সেটা একটা বড় প্রশ্ন। ফিলিস্তিন এবং ইসরাইল পৃথক দুটি রাষ্ট্রের ধারণা প্রথমবারের মতো বাস্তবতার দিকে এগোতে শুরু করে ১৯৯৩ সালে নরওয়ের অসলোতে ফিলিস্তিন-ইসরাইলের শান্তিচুক্তির মাধ্যমে। যেটা অসলো অ্যাকর্ড নামে পরিচিতি। এই চুক্তিতে পশ্চিম তীর এবং গাজায় সরকার পরিচালনার জন্য একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়। এটা গঠনের সময়সীমা ছিলো পাঁচ বছর। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা স্বীকার করে নেয় ইসরাইল রাষ্ট্রকে। চুক্তি অনুযায়ী অবশ্য খুব দ্রুতই পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা নিয়ে সম্ভাব্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের একটি কর্তৃপক্ষও গঠন করা হয়। কিন্তু তারপরই শান্তি প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়। নানারকম বাধা তৈরি হয়। অসলোতে দুই রাষ্ট্র সমাধান মেনে নেয়া হলেও সেই রাষ্ট্র কবে গঠন হবে তার কোনো সময়সীমা বেধে দেয়া হয়নি। এমনকি ইসরাইলের বাইরে আলাদা একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চারটি বিষয়েরও কোনো সমাধান করা হয়নি। এখানে মূল বিষয়গুলো হচ্ছে- দুই রাষ্ট্রের সীমান্ত কোথায়, কীভাবে নির্ধারণ হবে সেটা। জেরুজালেম কার অধীনে থাকবে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ভেতরে থাকা ইসরাইলি বসতিস্থাপনকারীদের কীভাবে সরিয়ে নেয়া হবে। এবং ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে ইসরাইলের ভেতরে থাকা যেসব ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুৎ হয়েছেন, তারা ইসরাইলে কীভাবে ফিরবেন। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, পাঁচ বছরের মধ্যে একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের পর এগুলো আলোচনার ভিত্তিতে পরে ঠিক করা হবে। কিন্তু সেটা আর কখনোই হয়নি। ইসরাইলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক মেইর লিটভ্যাক বলছেন, চুক্তি বাস্তবায়ন না হবার পেছনে দুইপক্ষেরই দায় ছিল। ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন দুইপক্ষেই চুক্তিবিরোধী শক্তিশালী দুটি গ্রুপ ছিলো, যারা এই ঐক্যমতকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কারণ, দুইপক্ষই বলছিল পুরো এলাকা তাদের এবং শুধু তাদেরই রাষ্ট্র হবে। ফিলিস্তিনে এটা ছিলো হামাস এবং ইসলামী জিহাদ। আর ইসরাইলে ধর্মীয় এবং জাতীয়তাবাদী গ্রুপগুলো। ফলে অসলো অ্যাকর্ড আর এগোয়নি। কিন্তু ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির পরপরই এর বিরোধিতায় হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ ইহুদিদের উপর হামলা শুরু করে। অন্যদিকে ইসরাইলে একজন ইহুদি কট্টরপন্থির হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন শান্তিচুক্তি করা দেশটির প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন। এরপর ১৯৯৬ সালে ইসরাইলে ডানপন্থিরা ক্ষমতায় আসার পর ইসরাইলের সরকারও আর শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে চায়নি। পরবর্তী বছরগুলোতে বিভিন্ন সময় দুই পক্ষের বৈঠক হলেও সমাধান আসেনি। এ সময় ইসরাইল মূলত নজর দিয়েছে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের উপর এবং জেরুজালেমকে তারা ইসরাইলের রাজধানীও ঘোষণা করেছে। সব মিলিয়ে ফিলিস্তিনে এখন যে ভৌগোলিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তাতে করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব কি না তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য সবার আগে দরকার ভূখণ্ড। কিন্তু পশ্চিম তীর যেটা কি না ফিলিস্তিনের অংশ হবে সেখানে এখন কয়েক লাখ ইহুদি বসতিস্থাপনকারী বসবাস করছেন। এছাড়া জেরুজালেমকেও ইসরাইল তার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং আমেরিকা সেটাকে স্বীকৃতিও দিয়েছে। ফলে ভৌগোলিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন এখন আর বাস্তবসম্মত নয় বলেই অনেকে মনে করেন। এদিকে আন্তোনিও গুতেরেস ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান সংঘাত নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্যে চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে ইসরাইল। জাতিসংঘের কর্মীদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকার। আন্তোনিও গুতেরেসের পদত্যাগ দাবি করে তেল আবিব আরো হুমকি দিয়েছে, জাতিসংঘকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার সময় এসেছে এবার। সম্প্রতি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ইসরাইলে ভয়ংকর এক হামলা চালিয়েছে হামাস। তবে এ হামলা যে হঠাৎ শূন্য থেকে হয়নি, এটাও সবাইকে বুঝতে হবে। ফিলিস্তিনের জনগণ ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারির শিকার। তারা তাদের ভূখণ্ড দখল করে অবৈধ ইহুদি বসতি দেখেছেন। তারা সহিংসতায় জর্জরিত হয়ে চলেছেন। জাতিসংঘপ্রধান আরো বলেন, গাজায় ইসরাইল যা করছে, তা স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশা যেমন হামাসের ভয়ংকর হামলার ন্যায্যতা দিতে পারে না। তেমনি আবার এ হামলার জেরে জাতিগতভাবে ফিলিস্তিনি জনগণকে শাস্তি দেওয়া কখনো ন্যায্যতা পেতে পারে না। আন্তোনিও গুতেরেসের বক্তব্যের পরপরই ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া জানায় ইসরাইল। গুতেরেসের এ মন্তব্যের পর সেদিনই তার পদত্যাগ দাবি করে বক্তব্য দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত গিলার্ড এরডান। তিনি বলেন, গুতেরেস জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত নন। তার পদত্যাগ করা উচিত। তিনি বলেছেন, জাতিসংঘের কর্মীদের ইসরাইলের ভিসা দেওয়া হবে না। ইসরাইলের এক সংবাদমাধ্যমকে এরডান বলেন, গুতেরেসের বক্তব্যের কারণে আমরা জাতিসংঘের কর্মীদের ভিসা দেব না। ইতিমধ্যে জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ সহায়তাবিষয়ক প্রধান মার্টিন গ্রিফিথসকে ভিসা দেওয়া হয়নি। এরপরও গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য আবারো আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে সহিংসতা বন্ধে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিশ্ব। আরব বিশ্বের পাশাপাশি রাশিয়া ও চীনও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালেও পশ্চিমা দেশগুলো এখনো ইসরাইলের অব্যাহত হামলা চালানোর অনড় অবস্থানের পক্ষে। এদিকে গাজায় খাবার ও পানির তীব্র হাহাকার চলছে। আগে থেকেই নাজুক পরিস্থিতিতে থাকা গাজার বাসিন্দাদের অনেকের এখন অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটছে। জাতিসংঘ বলছে, ইসরাইলি হামলায় গাজার অর্ধেকের বেশি বাসিন্দা গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। সামান্য ত্রাণসহায়তায় নির্ভরশীল তারা। দাতব্য সংস্থাগুলোর দেওয়া খাবারের জন্য মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে গাজাজুড়ে। সংস্থাগুলো বলছে, তাদের কাছে যে খাবার আছে, তা দিয়ে এতসংখ্যক মানুষের চাহিদা মিটছে না। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম বলছে, গাজাবাসীর বিরুদ্ধে অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সংস্থাটি বলছে, যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে খাদ্য বন্ধ করে দেওয়াকে কোনোভাবেই বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই।

গাজায় অব্যাহত বোমাবর্ষণে ক্ষতির শিকার হওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি, ওষুধ ও চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী সংকটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক গাজার হাসপাতাল। এতে করে স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থায় চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষকরা মনে করেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে। এটা বাস্তবায়ন করা ১৯৯০-এর দশকের তুলনায় খুবই কঠিন। কারণ, পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেমের ইহুদি বসতি। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির সময় এটা ছিলো এক লাখ ২০ হাজার। গেলো তিন দশকে ইহুদি বসতিস্থাপনকারী বেড়ে হয়েছে সাত লাখ। এছাড়া খোদ ইসরাইলের আইন অনুযায়ীই অবৈধ এরকম ইহুদি বসতিও আছে। এরকম বসতি সম্প্রসারণ এবং ইসরাইলের রাজনীতিতে এর প্রবল সমর্থনের কারণে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রতিও এখন আর ইসরাইলের আগ্রহ নেই। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরাও হামাস এবং ফাতাহ দুই দলে বিভক্ত। এবং তাদের মধ্যে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য কথা বলা বা শান্তি প্রক্রিয়া এগুনোর মতো একক এবং বিশ্বস্ত নেতা নেই। তাহলে কি দুই রাষ্ট্র সমাধান আর সম্ভব নয়? ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেইর লিটভ্যাক অবশ্য বলছেন, সুযোগ এখনো আছে। কিন্তু ইসরাইল কি দুই রাষ্ট্র সমাধান আর চায়? লিটভ্যাক বলছেন, ইসরাইল সেটা চায় না। এখানে ইসরাইলের সরকারি দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচনা করা হচ্ছে। তারা যেটাকে সমাধান মনে করে সেটা হচ্ছে, পরিস্থিতি যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকুক। এমনকি জেরুজালেম নিয়েও দুইপক্ষ ছাড় দিলে ঐক্যমতে আসা সম্ভব। কিন্তু ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে এখন যে নতুন যুদ্ধাবস্থা, সেখানে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা অচলাবস্থার পরিবর্তন কে করবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। মার্কিন গবেষকরা মনে করেন, এখানে আমেরিকাকেই আবার এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শান্তির উদ্যোগ নিলে সেটা সফল হতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকা যখন মধ্যপ্রাচ্যে কিছু করতে চেয়েছে, তখন সেটার বাস্তবায়নও হয়েছে। মিশর-ইসরাইল শান্তিচুক্তি, জর্ডানের সঙ্গে চুক্তি এমনকি সাম্প্রতিককালে আব্রাহাম অ্যাকর্ডের সবগুলোর পেছনে আমেরিকার ভূমিকা আছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে আমেরিকার আগ্রহ আছে কি না, এমন প্রশ্নে থেকেই যাচ্ছে। দুই যুগ আগে নাইন-ইলেভেনের পর আমেরিকার চোখ অসলো শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন থেকে সরে যায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। সেটা শেষ হলে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে ইরান, রাশিয়া, চীন নিয়ে। কিন্তু এখন আমেরিকাকে আবারো মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয় হতে হচ্ছে। কারণ এখানে অবহেলা করলে এর ফল সবাইকেই ভোগ করতে হবে, কিছু সময় পর পর সংঘাত সামনে আসবে। আমেরিকা শান্তির উদোগ নিলে হয়তো সেটা আশা দেখাতে পারে। কিন্তু এখন ইসরাইল-গাজা সংকট যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে এগুচ্ছে, সেখানে আমেরিকা-ইসরাইল কিংবা হামাস, শান্তির কথা কেউই বলছে না। সংকটটা এখানেই। যা-ই হোক শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয় তা সময়ই বলে দেবে।