সংকটে অর্থনীতি সমাধানের পথ বের করতে হবে

মো. মাঈন উদ্দীন

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের অর্থনীতি নানা সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া ও উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আমাদের পথ চলার কথা ছিল। সে লক্ষ্যে কি অর্থনীতি চালিত হচ্ছে? আমাদের সামনে রয়েছে অনেক সমস্যা তা হলো অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক। রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ, আছে সম্ভাবনাও। গত পাঁচ দশকে কখনো বেশি অর্জন কখনো কম অর্জন এভাবে আমরা চলেছি। আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া। আমাদের অর্থনীতিতে বর্তমানে যে সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করা উচিত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী অবস্থান, টাকার অবমূল্যায়ন, রিজার্ভ কমে যাওয়া, ব্যাংকিং খাতে নানা সমস্যা হুন্ডি ও মুদ্রাপাচার দুর্নীতি দিন দিন আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়ে যাওয়া এবং কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতার পাশাপাশি রয়েছে নীতির দুর্বলতা ও অথনৈতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আমলাতান্ত্রিক প্রভাব। এসব সমস্যাসমূহ আমরা অনায়াসে সমাধান করতে পারতাম। শুধু বাহ্যিক সমস্যা যেমন কোভিড-১৯ এর প্রভাব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের কারণে ঘটেনি বরং এর জন্য অব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলাহীনতা ও সিদ্ধান্তহীনতাও অনেকাংশে দায়ী। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ২০২১ অর্থবছরে আমদানি কমে গেলেও পরের বছর প্রায় দ্বিগুণ পণ্য আমদানি হয়। কিন্তু সেই সময়ে এটি নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়। যা পরবর্তীতে আরো দীর্ঘ হয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে অনেক দেশ ব্যবস্থা নিতে শুরু করলেও বাংলাদেশ তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ঋণের সুদ হারও বাজারে ওপরে ছেড়ে দেয়নি। বিশ্ববাজারে চড়া দামে পণ্য আমদানির সময় যেমন নিয়ন্ত্রণ হয় তেমনি বিশ্ববাজারে দাম কমার পর স্থানীয় বাজারে তা সমন্বয় হয়নি।

ডলার সংকটের কারণে একদিকে যেমন রিজার্ভ কমতে শুরু করে পাশাপাশি কড়াকড়ির কারণে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ে রপ্তানি খাতে। আমাদের যে পরিমাণ রপ্তানি হয় সে অনুযায়ী ডলার দেশে না এসে পাচার হয়ে যাওয়া। সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে আমাদের রাজস্ব আদায়ে, যে নিম্নহার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো খাতে বিনিয়োগ করতে না পারা, বৈদেশিক খাতের আয় বিনিয়োগের ভঙ্গুর অবস্থা, রিজার্ভের খারাপ অবস্থাসহ সব সূচকেই তা নেতিবাচক হয়ে পড়ছে। তথ্যউপাত্তের ঘাটতির পাশাপাশি বাজারের ওপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্ট্রিংগুইশ ও ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিবিসি বাংলায় এক স্বাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি মনে করি অর্থনীতি ভুল পথে চলছে। তবে পথ যতখানি ভুল হয়েছে সেটার চেয়ে বড় কথা হল- সেই পথ কখন ও কোথায় বাঁক নিতে হবে, কোথায় নামতে হবে সেটাকে আমরা সংস্কার বলি, সেখানে নীতি প্রণয়নে আর বাস্তবায়নে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। ফলে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।’ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত প্রতি মাসেই কমছে। আইএমএফ হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী বিজার্ভ বর্তমানে ২ হাজার ৯০ কোটি (২০.৯০ বিলিয়ন) ডলার। তবে সরকার আইএমএফকে যে হিসাব দেয় সে অনুযায়ী দেশের প্রকৃত রিজার্ভ ১ হাজার ৭০০ কোটি (১৭ বিলিয়ন) ডলার। অর্থনীতিবিদদের হিসাবে গত ২ বছরে প্রতি ১০০ কোটি ডলার করে রিজার্ভ কমেছে। ২০২২ সাল থেকে দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে। ২০২২ সালে যেখানে মাসে প্রায় ২০০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসত, সেখানে ২০২৩ সালে প্রথম তিন প্রান্তিকে প্রতি মাসে গড়ে ১৫০-১৬০ কোটি ডলার এসেছে। বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক অনুদান থেকে। এই চার খাতেই আয়ের ধারা নিম্নমুখী। বাংলাদেশ ব্যাংকের বহুমুখী সিদ্ধান্তে ও সুফল আসছে না। এতে টাকার মান আরো কমে যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়ছে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে হলে রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে। সেটি সম্ভব হচ্ছে না। কারণ বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি জুলাই-আগস্ট (২০২৩) কমেছে ২৮ শতাংশ ও এলসি খোলা কমেছে ১৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়েছিল ৩৪.৩৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৬.৬৭ শতাংশ। ১ বছরের ব্যবধানে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টের তুলনায় চলতি অর্ধবছরের এ সময়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। রেমিটেন্সের দিকে দেখলে তা দেখা যায় এ বছর জুনে রেমিট্যান্স এসেছে ২২০ কোটি ডলার, জুলাইয়ে তা কমে ১৬৭ কোটি ডালার, আগস্টে তা আরো কমে ১৬০ কোটি ডলার এসেছে। ৩ মাসের হিসাবে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৭৭ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছিল ১৫.১২ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে এসেছিল ১২.২৭ শতাংশ। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের একই সময়ে বাড়ার পরিবর্তে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৩.৫৬ শতাংশ। বৈদেশিক অনুদানের গতি ও নিম্নমুখী। ২০২১-২২ অর্থবছরে অনুদান বেড়ে ছিল ৫১.৭৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাইয়ে বেড়েছিল ৮৪.৩৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) একই সময়ে কমেছে ৩.১৩ শতাংশ। বৈদেশিক বিনিয়োগ ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ১৮৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে এসেছে ১৬১ কোটি ডলার। গত বছরে জুলাইয়ে এসেছে ১৭ কোটি ও চলতি বছরের একই সময়ে এসেছে ১৮ কোটি ডলার। এর বিপরীতে শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগ তুলে নেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।