ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ট্রেন দুর্ঘটনায় আর কত প্রাণ ঝরবে!

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী
ট্রেন দুর্ঘটনায় আর কত প্রাণ ঝরবে!

দেশে দুর্ঘটনার ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সড়ক পথে দুর্ঘটনার হার বেশির কারণে যাত্রীরা রেলপথ, নৌপথ কিংবা আকাশপথ বেশি ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ মনে করে। কিন্তু আসলে স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদভ্রমণ কতটুকু হচ্ছে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন! এই নিরাপদ ভ্রমনেও এখন সহজে নিরাপদ বলা যাচ্ছে না। কারণ, বর্তমানে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি ২৩ অক্টোবর বেলা ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে এগারসিন্দুর ট্রেনের সঙ্গে কনটেইনারবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে ১৯ জন যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। হতাহত আহতের সংখ্যাটা হয়তোবা আরো বেশি। রেলওয়ে সূত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি কনটেইনারবাহী ট্রেন ভৈরব স্টেশনে প্রবেশ করছিল। এর আগমুহূর্তে ভৈরব থেকে এগারসিন্দুর ট্রেন ঢাকার দিকে রওনা হয়েছিল। জগন্নাথপুর রেলক্রসিং এলাকায় এগারসিন্দুর ট্রেনের শেষের দুই-তিনটি বগিতে কনটেইনারবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন আঘাত করে। এতে এগারসিন্দুর ট্রেনের শেষের দুই-তিনটি বগি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. নাজমুল ইসলাম গণমাধ্যমকে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বলেছেন- ‘এগারসিন্দুর ট্রেনকে কনটেইনারবাহী ট্রেন এসে হিট করেছে। পার্শ্ব সংঘর্ষ বা সাইড কোলিশন হয়েছে। ডিজরিগার্ড অব সিগন্যালে (সিগন্যাল অমান্য) ছিল মালবাহী ট্রেনটি।’ এ দুর্ঘটনায় মালবাহী ট্রেনের গাফিলতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন ভৈরব রেলওয়ের স্টেশনমাস্টার ইউসুফ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুর্ঘটনার সময় শুধু এগারসিন্দুর ট্রেন চলাচলের জন্য স্টেশন থেকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মালবাহী ওই ট্রেনের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। ট্রেনটি দুটি সিগন্যাল ব্রেক করে, সতর্কতা অমান্য করে দ্রুতগতিতে এসে এগারসিন্দুর ট্রেনে ধাক্কা দেয়।’ উদ্ভুত ঘটনায় ভৈরবের আকাশ-বাতাস বেদনায় ভারি হয়ে গেছে। স্বজন হারানোর বেদনার করুণ সুর ভৈরবের রেল স্টেশনে। এ ট্রেন দুর্ঘটনার ঘটনাটি দেশে নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও অনেক ঘটনা কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

সম্প্রতি অপর আরেকটি ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পার্শ্ববর্তী দেশে ৩০ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে দুই ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ১৩ জন নিহত এবং ৪০ জন আহত হয়েছেন। মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে এনডিটিভি। খবরে বলা হয়েছে, বিশাখাপত্তম থেকে যাওয়া একটি বিশেষ যাত্রীবাহী ট্রেন আলামানদা ও কণ্টকাপাল্লের মাঝে কোথসাভাতসালায় অবস্থান করছিল। ট্রেনটির কাছে অন্য একটি ট্রেন আসার কোনো সংকেত পাঠানো হয়নি। ফলে বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রেনটির সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে যায়। রেলওয়ে সূত্র বলছে, মানুষের ভুলে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তারা বলছে, ট্রেন চালককে কোনো সংকেত দেওয়া হয়নি।

এদেশের ট্রেন দুর্ঘটনার বিগত তথ্য হলো- দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গত ৩ বছরের দুর্ঘটনার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, নিয়মিত প্রতিবছর রেলপথে দুর্ঘটনা বাড়ছে। এই সময়ে মোট ৫৮৫টি দুর্ঘটনায় ৭০১ জন মারা গেছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ২০৬ জন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে ১০৮টি রেলপথ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২২৮ জন এবং আহত হয়েছে ৫৪ জন। ২০২১ সালে ১২৩টি দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত এবং ৩৯ জন আহত হয়েছে। আর ২০২২ সালে ৩৫৪টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩২৬ জন নিহত এবং ১১৩ জন আহত হয়।

সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত খবরের তথ্যের ভিত্তিতে দুর্ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সড়ক হোক বা রেল দুর্ঘটনার জন্য পথ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্য অনেক কারণের সঙ্গে রেলপথ ভালো না থাকায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে রেলপথে ৬২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৬০ জন মারা গেছে। আহত হয়েছে ৭৮ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৫টি দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত এবং আটজন আহত হয়। ফেব্রুয়ারিতে ১৭টি দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত এবং পাঁচজন আহত হয়। মার্চে ১৯টি দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত এবং চারজন আহত হয়। এপ্রিলে ১১টি দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত এবং ৬১ জন আহত হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমাদের ৭০ শতাংশ রেলের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। একটা রেল গড়ে ৫০ বছরের মতো টেকে। এখন বেশির ভাগ লাইনের রেলের অবস্থা ভালো নেই। বিপরীতে যে পরিমাণ রক্ষণাবেক্ষণ হওয়া দরকার, সেটা তো হচ্ছেই না। এ জন্যই ট্রেনের লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা বেশি।’ (সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৩ মে, ২০২৩)। এছাড়াও ২০১৯-২০ অর্থবছরের দুর্ঘটনার তথ্য আছে পরিসংখ্যান দপ্তরে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট ৮০টি দুর্ঘটনার মধ্যে ৭২টিই ঘটেছে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে। অঙ্কের হিসাবে এটা ৯০ শতাংশ। এর পর থেকে গত তিন অর্থবছরে রেল থেকে আর কোনো চূড়ান্ত পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়নি। ওই অর্থবছরের দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ট্রেন চলার সময় বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় সাতবার দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ২.৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর ৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনা মানুষের ভুলের জন্য হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ১২ বছরে রেললাইনে ২ হাজার ৬০১টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ট্রেনের চলার পথে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার দুর্ঘটনা ২৫৮টি। এসব দুর্ঘটনায় ৩৪৩ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ট্রেনের যাত্রী ৩২ জন, রেলের লোক ৪৩ জন। বাকি ২৬৮ জন ট্রেনের আরোহী নয়। অর্থাৎ দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া অন্তত সাড়ে তিন গুণ মানুষ ট্রেনের আরোহী নয়। দেশের এসব অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, তদন্ত কমিটি গঠন হয়, প্রতিবেদন দাখিল হয়; কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন থেকে দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করে পরবর্তীতে এ দুর্ঘটনা রোধে তেমন সতর্কতা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না থাকার ফলে পুনরায় একই কারণ ও অবহেলায় আবার দুর্ঘটনা ঘটে। এমন বিষয় সত্যিই খুব দুঃখজনক। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যাতায়াতমাধ্যম হলো- রেল যোগাযোগমাধ্যম। এ রেলের দীর্ঘদিনের সনাতন ব্যবস্থাপনা তেমন পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলে যে হারে দেশের অন্যান্য খাতে উন্নয়ন হয়েছে, সে হারে রেল খাতে উন্নয়ন হয়নি। রেলের এখনও অনেক ব্যবস্থাপনা সনাতন পদ্ধতিতেই পরিচালনা হয়। খুলনা থেকে উত্তরবঙ্গে তথা চিলাহাটি পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য সকাল-সন্ধ্যা দুটো ট্রেন চলে। ট্রেন দুটো হলো- রূপসা ও সীমান্ত এক্সপ্রেস। উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গ যাতায়াতের সবচেয়ে নিরাপদ যাতায়াতমাধ্যম মনে করে যাত্রীরা এই ট্রেন দুটোকেই। এই ট্রেনের যাত্রীরা স্বাধীনতা পরবর্তী সময় কতটা সুবিধা পেয়েছে, যাতায়াতে সেটাই বড় প্রশ্ন। আমি এই ট্রেন দুটোর যাত্রী হয়ে দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর যাতায়াত করছি; কিন্তু আমূল উন্নয়ন তেমন চোখে পড়ার মতো নেই। অনেক পদ্ধতিই সনাতনে চলছে। এই ট্রেন দুটোয় প্রতিটি বগিতেই যাত্রীদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছার আগে সাউন্ডবক্সে বলে দেওয়া হয়, স্টেশনের নাম ও সতর্কতা। কিন্তু কোনো কোনো দিন এ সাউন্ডবক্স আর বাজেনা, তখন যাত্রীরা পড়ে ভোগান্তিতে। এসি বগিটাও সংযুক্ত থাকে, থাকে না। প্রায় সময় নানান কারণে নির্দিষ্ট সময় ট্রেন নেই, লেটে ছাড়ে, যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়ে। এই ট্রেন দুটোতে যাত্রীদের প্রচুর ভিড়। কোনো কোনো দিন বগিতে যাত্রী দাঁড়ানোরও জায়গা থাকে না। যাত্রীর ভিড়ে তাড়াতাড়ি ট্রেনে উঠতে-নামতে গিয়ে অনেক যাত্রী দুর্ঘটনার শিকার হয়। দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি- যাত্রীদের কল্যাণার্থে নতুন ট্রেন যুক্ত হবে, তা কবে হবে কেউ জানে না। উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গের ট্রেন যাত্রীদের দুর্ভোগ আর কতকাল পোহাতে হবে, কেউ জানে না। রেল সেবার মান উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের আরো উদ্যোগী হতে হবে। সেবার মান বাড়লে দুর্ঘটনার হার কমতে পারে। ট্রেন দুর্ঘটনা কমাতে রেল ব্যবস্থাপনাকে আরো আধুনিকায়ন করতে হবে। সনাতন ব্যবস্থাপনা থেকে দ্রুত আধুনিক ব্যবস্থাপনায় উন্নীত করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে রেল যোগাযোগের আধুনিকায়ন অত্যান্ত জরুরি। রেল খাতের আধুনিকায়ন নিয়ে এলে ও অব্যবস্থাপনা রোধ করলে, রেল দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত