ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কৃষি শিল্প ও প্রান্তিক কৃষক

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
কৃষি শিল্প ও প্রান্তিক কৃষক

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে এখন একটি নতুন ধারা সংযোজিত হচ্ছে তা হলো- কৃষি পর্যটন। বর্তমান সরকারের কৃষিমন্ত্রী কৃষিকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করেছেন। বৃহৎ শিল্পের মতো কৃষির পরিধিগত আকার সেই দিকে ধাবিত হয়ে যাচ্ছে। এখন কৃষি শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণটা বেড়েছে, গ্রামের প্রান্তিক কৃষিজীবী মানুষ আর কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পারছে না। এর ফলাফলটা কি তা পর্যবেক্ষণ করা দরকার। কৃষি শিল্পে এখন প্রয়োজন বৃহৎ আকারের পুঁজি বিনিয়োগ। তাই কৃষিও ব্রিটিশ শাসনামলের নীল চাষের মতো আকার ধারণ করছে। এদেশে একসময় নীল ব্যবসায়ীরা পুঁজি বিনিয়োগ করে প্রান্তিক চাষিদের জমি লিজ নিয়ে নিত, যার ফলে প্রান্তিক চাষিরা আর ধান বা অন্য কৃষি ফসল উৎপাদন করতে পারতেন না। এই নীল চাষ ফরে এদেশের প্রান্তিক কৃষকদের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। নীল চাষের দুরবস্থার কথা আজও বাংলা জনপদের মানুষের হৃদয়ে বহমান। বাংলাদেশের শস্যভান্ডার হলো বরেন্দ্র অঞ্চল। বরেন্দ্র ও হাওর এলাকা দেশের সিংহভাগ চালের জোগান দেয়। বর্তমানে এই অঞ্চলের জমিতে ধান চাষ না করে অন্যান্য কৃষিকাজ করা হয়। প্রান্তিক ভূমি মালিকদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা এই জমিগুলো ১০ থেকে ৩০ বছরের জন্য লিজ নিয়ে নিচ্ছেন। লিজ নেয়া জমিতে ব্যবসায়ীরা চাষ করছে ড্রাগন, পেয়ারা, উফশী জাতের আম চাষ, কমলা মাল্টা, লেবু ও অন্যান্য ফল ও মসলার। অথচ এই জমিগুলো লিজ দেয়ার আগে প্রান্তিক কৃষক বছরে তিনটি ফসল ফলাতেন ক্ষুদ্র জমিগুলোতে। বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের ভৌত অবকাঠামোর হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন। দেশের প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে পিচঢালা পথে যোগাযোগের ব্যবস্থা। এই রাস্তাগুলো নির্মাণের ফলে উপজেলা জেলা বিভাগীয় শহরসহ রাজধানীর সাথে যোগাযোগটা সহজতর হয়েছে। গ্রামের উৎপাদিত কৃষিপণ্য পরিবহনের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে পৌঁছে যায় শহরে। শহরের লোকরা ছুটি কাটাতে গ্রামগুলোতে আসতে পারছে সহজেই, তাই লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা এখন বিনিয়োগ করছে কৃষি পর্যটনে। কৃষি পর্যটন প্রসারের ফলে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে গড়ে উঠছে রিসোর্ট। এই রিসোর্টগুলো অনেকটা কৃষি খামারের মতো। শহরের ধনী ধনী ব্যবসায়ীরা গ্রামের জমি বেশি দাম দিয়ে কিনে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলছে এই রিসোর্ট ও বিনোদনকেন্দ্র। নিজেদের রিসোর্টের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ইচ্ছামতো পুকুর খনন, সুইমিং পুল নির্মাণ করছে। এদিকে সরকারিভাবে তিন ফসলি জমি কেটে পুকুর বানানোর বিষয়টি আইনগতভাবে বৈধ না। কিন্তু পুঁজিওয়ালার অর্থের জোরে আবাদি জমি কেটে ইচ্ছামতো রিসোর্টের পুকুর বানাতে পারছেন। অন্যদিকে একজন প্রান্তিক কৃষক নিজের জমিতে পুকুর খনন করতে গেলে প্রশাসন বাধা দেয়। এমনকি এই কারণে জেল-জরিমানাও করা হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ আদালত এই বিষয়টি দেখে থাকে। তবে বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায়, বৃহৎ আকারের রিাসোর্ট বা বিনোদন কেন্দ্রের জন্য তা প্রযোজ্য হয় না। বরেন্দ্র এলকায় বিশাল বিশাল মাঠের রয়েছে নালার মতো অসংখ্য ছোট ছোট নদী আকৃতির খাল। যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় খাঁড়ি। এক সময় এই খাঁড়িগুলো ছিল বরেন্দ্র এলাকার ভূ-উপরিস্থ জলের জোগানদার। বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের ডিপ টিউবওয়েল আসার আগে এই খাঁড়ির পানি ছিল সেচব্যবস্থার একমাত্র অবলম্বন। বর্তমানে বৃহৎ আকারে কৃষি আবাদ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদ চালু হওয়ার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রকৃতিগত নানা ধরনের পরির্বতন হচ্ছে। বরেন্দ্র এলাকার বিশাল বিশাল ফসলের মাঠে গড়ে উঠছে বিভিন্ন বাগান, রিসোর্ট ও কৃষি খামার। রিসোর্ট নির্মাণের নকশাগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে ভূমি নেয়া হচ্ছে, তাতে ভূমির প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য নষ্ট হচ্ছে; কারণ নকশাটি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে জমির মাটি কেটে পরিবর্তন করা হয়, যার জন্য দেখা যায় অনেক জায়গায় খাঁড়িগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বরেন্দ্র এলকায় ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে আবাদের জমিগুলো ছিল স্তরে স্তরে অর্থাৎ দেখতে অনেকটা সিঁড়ির মতো। কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের ফলে উঁচু নিচু ধাপ ধাপ আকারের জমির মাটি কেটে একটি লেবেলে করা হয়, এর ফলে বরেন্দ্র এলাকার আদি ভৌগোলিক চিত্রটা পাল্টে যাচ্ছে, এর কু-প্রভাব অচিরেই পরিবেশের ওপর পড়বে। বর্তমানে ধানের মূল্য অন্য কৃষিপণ্যের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম। তাই বড় বড় কৃষি খামারিরা ধান উৎপাদনের চেয়ে অন্য কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য চাষাবাদ করতে আগ্রহী, যার জন্য উফশী জাতের ধান আসার পর যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল এই অঞ্চলে তা আর হচ্ছে না। কৃষির উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় প্রান্তিক কৃষকরা পুঁজির অভাবে চাষাবাদ থেকে সরে আসছে। নিজের ভিটে-মাটি বাদে বাকি জমি এই বড় খামারিদের কাছে লিজ দিয়ে দেন। আর এই লিজের টাকা দিয়ে সংসার চালায়। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় কৃষক আর লিজের টাকা দিয়ে সংসার চালাতে পারছেন না। তাই দেখা যায়, অনেক প্রান্তিক কৃষকই লিজ নেয়া মালিকের কাছে নিজের জমিটুকু বিক্রি করে দেন। প্রান্তিক কৃষক তার চাষের জমিটুকু বিক্রি করে দিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসা আরম্ভ করেন। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষুদ্র ব্যবসার অবস্থাটাও প্রান্তিক কৃষির মতোই। ক্ষুদ্র ব্যবসা করতে গিয়ে পুঁজি হারিয়ে তারা শ্রমিকে পরিণত হয়। বাংলাদেশে শুধু ভিটে-মাটি আছে, কিন্তু অন্য কৃষিজমি নাই- এমন পরিবারের সংখ্যা বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে বাড়ছে দিন দিন। তাই কৃষিকে যে শিল্পের রূপ দেয়া হচ্ছে, তা বাংলাদেশের প্রান্তিক কৃষকদের কতটা সুফল বয়ে আনবে, তা দেখা এবং এই বিষয়ে একটি গবেষণা চালানো দরকার। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশই প্রান্তিক কৃষক। তাই এই প্রান্তিক কৃষক প্রতিযোগিতামূলক কৃষিব্যবস্থার সাথে বিনিয়োগ করে কীভাবে টিকে থাকতে পারে, তারও একটি কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এই বৃহৎ আকারের জনগোষ্ঠী যদি শ্রমিকে পরিণত হয় তাহলে এদের কর্মসংস্থানের কী ব্যবস্থা হবে? এই বিষয়টি নিয়ে সরকারি কোনো সঠিক পরিকল্পনা নেই। যথাযথ কর্মসংস্থান করতে না পারলে বাড়বে বেকারত্ব। বেকারত্বের কারণে বাড়ছে হতাশা, আর হতাশা থেকে জন্ম নিচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। সামাজিক অস্থিরতার কু-প্রভাবে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদকাসক্তি বাড়ছে।

পুঁজির আগ্রাসনের ফলে দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটির শিল্পগুলো হারিয়ে গেছে, যেমন মৃৎ, তাঁত, কামারসহ ক্ষুদ্র শিল্পগুলো এখন আর গ্রামে নেই। বর্তমানে যে হারে কৃষির দিকে পুঁজির আগ্রাসন হচ্ছে এর ফলে দেখা যাবে একসময় কৃষির যে বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থাটা এখনো বিদম্যান আছে, তাও আর থাকবে না। যদিও বর্তমানে সব ধরনের কৃষি পণ্যের উৎপাদন হাইব্রিড পদ্ধতিতে যার পুষ্টিমান আগেকার মতো আর নেই। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাটা ধরে রাখতে হলে কৃষিতে পুঁজির আগ্রাসনটা রোধ করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত