ইলিশ উৎপাদন কেন কমছে?

ফারিয়া হোসেন

প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

নদীমাতৃক বাংলাদেশে পানিদূষণ ক্রমাগত বাড়ছে। পানি দূষণের কারণে সুস্বাদু ইলিশের বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা আশঙ্কা দিয়েছে। ২০১৭ সালে ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় ইলিশের বিশ্ববাজার সম্প্রসারণের এই সময়ে নতুন শঙ্কা দেখা দিয়েছে পানি দূষণে উৎপাদনে ধস নামতে পারে বলে। পলিথিন, প্যাকেটজাত খাবাবের উচ্ছিষ্ট, পশুবর্জ্য, মানুষের মলমূত্র প্রভৃতি অনবরত পানিতে মিশে পানিকে দূষণ করছে। পাশাপাশি নদীর নিকটস্থ শিল্পবর্জ্য, নদীতে চলাচলকারী নৌযান, জাহাজ প্রভৃতির নির্গত তরল বর্জ্যে নদীর পানিকে মারাত্মকভাবে দূষণ করছে। এ কারণে ইলিশ উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে, পদ্মা ও মেঘনা নদীতে পানির গুণগত মানের অবনতি হচ্ছে। সেই সঙ্গে কমছে ইলিশের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের পরিমাণ। বর্ষার সময় ইলিশ মূলত দুটি কারণে সাগর ছেড়ে নদীর দিকে আসতে শুরু করে। একটি কারণ হলো খাবার সংগ্রহ, দ্বিতীয়টি প্রজনন। ইলিশের এই আগমনে নদীর পানির গুণাগুণ বড় নিয়ামক ভূমিকা রাখে। পানির মান ভালো হলে ইলিশের এই বিহার নির্বিঘ্ন হয়, জেলের জালেও আটকা পড়ে বেশি। পদ্মা ও মেঘনা নদীতে ইলিশ ধরা পড়ে অপেক্ষাকৃত বেশি। সাধারণত মেঘনা নদীর মুন্সীগঞ্জের ষাটনল, চাঁদপুরের আনন্দবাজার সফর মালি, মতলবের লঞ্চঘাট, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা ও মেঘনার মিলনস্থল এলাকার পানির মান দেখা হয়। আর পদ্মার শরীয়তপুরের তারাবুনিয়া, ভোমকারা, কাছিকাটা, মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া, পাবনার ঈশ্বরদী, রাজশাহীর গোদাগাড়ী এলাকার মান দেখা হয়। ওয়ার্ল্ডফিশের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। ইলিশ পছন্দ করে না- এমন বাঙালি দেশে ও বিদেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ইলিশ স্বাদে ও গুণে অতুলনীয়। সাগর ও নদী দুই জায়গাতেই ইলিশের বিচরণক্ষেত্র। বিগত বছরগুলোতে ইলিশ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল এবং এমন প্রেক্ষাপটে মা ইলিশ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইলিশ গবেষকরা বলেছেন, ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে পানি দূষণের কারণে। এরই মধ্যে নদীতে ইলিশের উৎপাদন কমে গেছে। ইলিশের যেসব বিচরণক্ষেত্র আছে, সরকারের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট সেসব স্থানে দীর্ঘ সময় ধরে পানির মান পরীক্ষা করে আসছে। এ প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা প্রতি বছর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও-ডিসলভ অক্সিজেন), পিএইচ, পানি ও বায়ুর তাপ, হার্ডনেস (ক্ষারত্ব), অ্যামোনিয়ার পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করেন। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জলজ প্রতিবেশে দূষণ যেকোনো মাছের জন্যই ক্ষতিকর। তবে ইলিশ অনেক বেশি সংবেদনশীল মাছ এবং দূষণের ফলে প্রতিবেশের সামান্য পরিবর্তন ইলিশ নিতে পারে না। সে কারণেই ইলিশ তার গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। পানিতে অ্যামোনিয়ার বৃদ্ধি ইলিশের খাবারের চাহিদায় পরিবর্তন করতে পারে। সূত্র জানায়, ইলিশের বিচরণক্ষেত্রে পানির মান বিচারে অন্যতম নিয়ামক হলো পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন বা ডিও। যদি ডিওর পরিমাণ প্রতি লিটারে ৫ মিলিগ্রামের কম হয়, তবে তা জলজ পরিবেশের জন্য কম উপযোগী বলে বিবেচিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, পদ্মায় গত ৫ বছরে ডিওর মান কমেছে। ২০১৮ সালে পদ্মার পানিতে ডিওর গড় মান ছিল ৮ দশমিক ৭০ এবং এরপর থেকে প্রায় প্রতি বছর কমছে। ২০২২ সালে ডিওর মান ছিল ৫ দশমিক ৪১। মেঘনায় ২০১৮ সালে ডিওর গড় মান ছিল ৮ দশমিক ৪০ এবং এটি ২০২২ সালে কমে ৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ হয়েছে। নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে গঠিত রাসায়নিক যৌগ হলো অ্যামোনিয়া। পদ্মায় ২০১৮ সালে পানিতে অ্যামোনিয়ার গড় উপস্থিতি ছিল শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। মেঘনায় পানিতে অ্যামোনিয়ার গড় উপস্থিতি শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ এবং এটি গত বছর শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ হয়েছে। এক তথ্যে দেখা গেছে, অ্যাসিড ও ক্ষারের পরিমাপক হলো পিএইচ। জলজ প্রাণীর সহনীয় পরিবেশের ক্ষেত্রে পিএইচ সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৮-এর মধ্যে থাকতে হয় কিন্তু ৭-এর নিচে নয়। পদ্মা নদীতে পিএইচের গড় উপস্থিতি ছিল ৮ এবং গত বছর এর পরিমাণ কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭। মেঘনায় ২০১৮ সালে পিএইচের উপস্থিতি ছিল ৮ দশমিক ১৩ এবং ২০১৮ থেকে ২০২২-এর মধ্যে পদ্মায় পানির তাপমাত্রা প্রায় ২৫ থেকে বেড়ে ৩০ ডিগ্রি হয়েছে। এ সময় অবশ্য মেঘনায় পানির তাপ ২৭ দশমিক ৪০ থেকে কমে প্রায় ২৭ হয়েছে। গবেষকরা বলেন, নদীর পানিদূষণের ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ইলিশের আবাসস্থল। এছাড়া, মা ইলিশ অল্প বয়সেই ডিম দিচ্ছে এবং এটা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়। কারণ, এই মাছ যখন বাচ্চা দেয়, স্বাভাবিক কারণেই সেটি ম্যাচিউরড বা পরিণত হয় না। ইলিশ গবেষকরা প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন- আগামী দু-তিন বছর সর্বোচ্চ ৭ লাখ টন পর্যন্ত ইলিশ আহরণ করতে। এর বেশি করলে প্রাকৃতিক যে মজুত আছে, সেটার ওপর প্রভাব পড়তে পারে। মা ইলিশ বছরে সাধারণত দুবার ডিম দেয়, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর (ভাদ্র মাস থেকে মধ্য কার্তিক) ও ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল (মধ্য পৌষ থেকে মধ্য ফাল্গুন)। তবে দ্বিতীয় মৌসুমের তুলনায় প্রথম মৌসুমে প্রজনন হার বেশি। একটি মা ইলিশ প্রতি মৌসুমে একবারে সর্বোচ্চ ১ থেকে ২.৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ১০ থেকে ২৩ লাখ পরিমাণ ডিম পাড়ে। ইলিশ পোনা ৬ থেকে ১০ সপ্তাহে ১২ থেকে ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড়ো হয়। তখন তাদের জাটকা বলে। একটি জাটকা মাছ পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিণত হতে সময় নেয় ১ থেকে ২ বছর। তখন আয়তনে ৩২ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার এবং ওজনে ১ থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। জাটকা মা ইলিশের সঙ্গে সমুদ্রে চলে যায়। সেখানে পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিণত হয়ে আবার প্রজননকালে নদীতে ফিরে আসে। এত পরিচর্যার পরও মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ জাটকা সমুদ্রের নোনা পানিতে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। কারণ, ডিমের প্রায় ৩০ শতাংশ অন্য মাছ ও প্রাণীদের আহারে চলে যায়। ১০ শতাংশ অপুষ্টিজনিত কারণে শুরুতেই নষ্ট হয়ে যায়। পরে প্রায় ২০ শতাংশ পোনা এবং ৩০ শতাংশ জাটকা হিসেবে জেলেদের জালে ধরা পড়ে।