ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিক্রিতে অনিহায় হুমকির মুখে দেশীয় গাছের প্রজনন

বাপ্পি সরদার
বিক্রিতে অনিহায় হুমকির মুখে দেশীয় গাছের প্রজনন

সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে হুমকির মুখে। একদিকে উন্নত রাষ্ট্রগুলো মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ করছে অন্যদিকে বাংলাদেশের উন্নয়নের নামে গাছপালাকে নির্বিচারে কর্তন করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিদেশি প্রজাতির গাছের আগ্রাসনে দেশীয় প্রজাতির গাছ বিক্রিতে অনিহা নার্সারি মালিকদের। স্বাধীনতাণ্ডপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ৫ হাজার প্রজাতির দেশীয় গাছ থাকলেও এখন তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৮২৮ প্রজাতিতে। এর অন্যতম প্রধান কারণ বিদেশি গাছ আমদানি এবং অপরিকল্পিত সবুজয়ান। কিন্তু বিদেশ থেকে গাছ (উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য) আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার জন্য ২০১৫ সালে ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) থেকে আমদানির অনুমতিপত্র নেওয়ার কথা বললেও বিধি-নিষেধ কেউ মানছে না। ডেসট্রাকটিভ ইনসেক্টস অ্যান্ড পেস্টস রুলস- ১৯৬৬ অনুযায়ী, উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে কোনো আমদানিকারক অনুমতিপত্র ছাড়াই এলসি খুলে উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য আমদানি করছেন। এতে একদিকে আমদানি পণ্যের গুণগতমান বজায় রাখা কঠিন হচ্ছে, অন্যদিকে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত কৃষিজাত পণ্য আমদানি কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটছে। এছাড়াও বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে দ্রুত বর্ধনশীল বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। এগুলো জ্বালানি সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখে ঠিকই, তবে ক্রমাগত মাটি ও পরিবেশের সর্বনাশ করে চলেছে। বিদেশি বৃক্ষগুলো বাংলাদেশের মানুষই যেমন এনেছে, আবার কিছু উদ্ভিদ নিজেই বাংলাদেশে ইকোসিস্টেমে বা বাস্তুসংস্থানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বিদেশি প্রজাতির রেইনট্রি, সেগুন, আকাশমনি, আকাশি, শিশু, বাবলা, ইউক্যালিপটাস জাতীয় গাছের জন্য প্রচুর জায়গার দরকার হয়। এগুলো দেশি গাছের তুলনায় অনেক দ্রুততার সঙ্গে বেশি পরিমাণে পুষ্টি ও পানি শোষণ করে। তাই এসব বৃক্ষের আশপাশে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ বাঁচতে পারে না। ব্রিটিশ আমলে বৈধভাবেই দেশে আসে রেইনট্রি, মেহগনি, চাম্বল ইত্যাদি। আশির দশকে আসে আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস, শিশু, ইপিল ইপিল, বাবলা ও খয়ের জাতীয় গাছ। আর বিভিন্ন সময় অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করেছে- রিফুজিলতা, স্বর্ণলতা, মটমটিয়া, পিসাইস, পার্থেনিয়াম, কচুরিপানা ইত্যাদি অন্যতম। অতীতে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির বৃক্ষ ছিল। কিন্তু বর্তমানে এক হাজারের অধিক বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বিদেশি এসব আগ্রাসি বৃক্ষ। আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশীয় বট, কদম, হিজল, জারুল, তমাল আর বাংলা মানেই বট, পাকুড়, ডুমুর, আম, জাম, শিমুল, পলাশ, হিজল, ছাতিম, কদম, শাল, তাল, তেঁতুলসহ অজস্র দেশি বৃক্ষে আচ্ছাদিত। বাংলা মানেই জুঁই, চামেলি, মালতি, গন্ধরাজ, ভাঁট ফুলসহ অজস্র লতাগুল্মের বাহার। বাংলার এসব গাছ গাছালিকে কেন্দ্র করেই বাস করে বহু প্রজাতির পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ। মানুষ বেড়েছে ভারসাম্যহীনভাবে। চাহিদা বেড়েছে খাদ্য, বস্ত্র ও আবাসের। সেই সঙ্গে বেড়েছে ভোগ-বিলাস, বিত্তবৈভব, লালসা ও নগদ প্রাপ্তির অসীম চাহিদা। তাই চলছে প্রকৃতি লুণ্ঠনের অজগ্র আয়োজন। কলকারখানার জন্য উন্নয়নের নামে গাছগাছালি সাবাড় করে উজাড় হচ্ছে বন। তা আবার উদ্ধারের নামে রাষ্ট্রের লাখো কোটি টাকায় শত শত প্রকল্পে চলছে সবুজায়নের এক অদ্ভুত আয়োজন। রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি সর্বস্তরে চলছে বাংলার বৃক্ষ-প্রকৃতি বিনাশের কাজ। বিদেশি প্রজাতির গাছের আগ্রাসন রোধ ও দেশীয় প্রজাতির গাছের প্রজনন বৃদ্ধিতে পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হলো সেগুলো হলো- (১) বিদেশি প্রজাতির গাছ আমদানির ক্ষেত্রে কোন কোন গাছ আমদানি করা যাবে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের দ্বারা তালিকা প্রণয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী এলসি খোলার ক্ষেত্রে কয়েকজন পরিবেশবিদের সুপারিশ কর্তৃক জমা দিতে হবে। (২) দেশের সব নার্সারিতে দেশীয় গাছপালা সংরক্ষণে বাধ্য করা এবং বাৎসরিক জেলা ও উপজেলার বন মেলায় নার্সারি মালিকদের ধারণা দিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা পাশাপাশি সহজ শর্তে ঋণ সুবিধার ব্যবস্থা করা। (৩) এরইমধ্যে সারা দেশে ক্ষতিকর বিদেশি প্রজাতির গাছ কর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং সরকারিভাবে বিনামূল্যে বন বিভাগ থেকে দেশীয় গাছ বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। (৪) দেশীয় ফলমূল ও বনজ বৃক্ষের মাদার ট্রি থেকে বীজ উৎপাদনে গবেষণা জোরদারের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে সব উদ্ভিদ ও প্রাণী বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে জাতীয় গবেষণা পরিষদ তৈরি করা। (৫) সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ে পরিবেশবাদী সব সংগঠনের সমন্বয়ে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি আগামী এক বছরে ২ কোটি দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষরোপণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, সবুজ আন্দোলন পরিচালনা পরিষদ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত