ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাধাহীন উড়াল সড়ক

বর্তমান সময়ের নতুন মাইলফলক

প্রদীপ সাহা
বর্তমান সময়ের নতুন মাইলফলক

যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নে দেশে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়ালসড়ক। ঢাকার যানজট কমাতে বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে উড়ালসড়ক একটি। ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ উড়াল সড়কটি উদ্বোধন করা হয় এবং পরের দিনই খুলে দেওয়া হয় জনগণের বহুল কাঙ্ক্ষিত এই উড়ালসড়ক। এটি ঢাকা বিমানবন্দরের কাছ থেকে কাওলা পর্যন্ত যাবে। তারপর সেটি বনানী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, মানিকনগর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত যাবে। তেজগাঁও থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত উড়ালসড়ক চালু হবে আগামী বছরের (২০২৪) জুনে। কাওলা থেকে বনানী পর্যন্ত উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার, বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত দূরত্ব ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার এবং মগবাজার রেলক্রসিং থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। উড়ালসড়কটির দৈর্ঘ্য মোট ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। পুরো উড়ালসড়কে ৩১টি স্থান দিয়ে যানবাহন ওঠাণ্ডনামা (র‌্যাম্প) করার ব্যবস্থা রয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। বিমানবন্দর থেকে সাভার ইপিজেড পর্যন্ত প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি উড়ালসড়ক নির্মাণ করছে সেতু বিভাগ। সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে চীন। এটির নাম দেওয়া হবে ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক। আগামী ২০২৬ সালে এটি চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই উড়ালসড়কটির কাজ শেষ হলে প্রকল্পের পুরোপুরি সুফল মিলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। উড়ালসড়ক ব্যবহারের জন্য প্রতিটি যানবাহনকে নির্দিষ্ট হারে টোল প্রদান করতে হয়। উড়ালসড়কে ১১টি টোল প্লাজা রয়েছে। প্রতিটি টোল প্লাজাতেই টোল আদায় করা হবে। এর মধ্যে ৫টি হবে উড়ালপথে এবং বাকি ৬টি হবে নিচে। পুরো উড়ালসড়কটি চালু হলে যানবাহন পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ২০ মিনিট এবং কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত লাগবে ১২ মিনিট। বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশে ১৫টি স্থান দিয়ে যানবাহন ওঠা-নামার ব্যবস্থা আছে। এই অংশে বিমানবন্দর এলাকায় দুটি, কুড়িলে তিনটি, বনানীতে চারটি, মহাখালীতে তিনটি, বিজয় সরণিতে দুটি এবং ফার্মগেট এলাকায় একটি স্থানে যানবাহন ওঠা-নামা করতে পারবে। এই উড়ালসড়কে অটোরিকশা, সাইকেল এবং মোটরসাইকেল চলতে পারবে না। পথচারীদের হাঁটারও কোনো ব্যবস্থা নেই। টোল প্লাজা ছাড়া চার লেনের এই উড়ালসড়কের কোথাও যানবাহন থামানোর কোনো সুযোগ নেই। যানজট এড়িয়ে ঢাকার উত্তর-দক্ষিণমুখী যানবাহনের যাতায়াত নিশ্চিত করতে চালু হলো দ্রুতগতির এই উড়ালসড়ক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা উড়ালসড়ক পুরোপুরি চালু হলে বিভিন্ন যানবাহন যানজট এড়িয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যেতে পারবে। ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক চালু হলে ইপিজেড ও উত্তরবঙ্গের যানবাহন যানজট এড়িয়ে যেতে পারবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পথে। এতে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল ও পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারবে। একইভাবে উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলো ঢাকাকে বাইপাস করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে। এতে সহজেই নিচে সড়কের চাপ কমবে। এখন বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট দুই ঘণ্টার পথ যাওয়া যাবে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে। ফলে মানুষের কর্মঘণ্টা বাঁচবে এবং মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজধানীতে অসহনীয় যানজটে মানুষের ভোগান্তি ও অনেক কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। শুধু ঢাকার যানজটের কারণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ হয়েছে মোট জিডিপির ২ দশমিক ৯ ভাগ। ২০১৫-১৬ সালের নতুন ভিত্তি বছরের হিসাবে অর্থমূল্যে এ ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। উড়ালসড়ক চালু হওয়ার পর চিরচেনা ঢাকার চেহারা পুরোপুরি বদলে গেছে। মানুষের সময়ও কম লেগেছে। দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখবে এই উড়ালসড়ক। অর্থনীতিবিদদের মতে, ঢাকার যানজটে প্রতি মাসে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। এর ফলে কর্মজীবীদের উৎপাদনশীলতা কমে যায়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জিডিপিতে।

নকশা অনুসারে, উড়ালসড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ কর হয়েছে। তবে কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত গতিবেগ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। মূল উড়ালসড়কে ওঠা-নামার জন্য র‌্যাম্পে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। ৬০ কিলোমিটার গতির একটি গাড়ি মাত্র ১০ মিনিটে কাওলা থেকে ফার্মগেট পৌঁছতে পারবে। কর্মকর্তারা বলেন, ‘প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার যানবাহন এই উড়ালসড়ক দিয়ে যেতে পারবে।’ উড়ালসড়ক ঢাকার যানজট এবং যাতায়াতের খরচ অনেকাংশ কমিয়ে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। উড়ালসড়কটির প্রকল্প নেওয়া হয় ২০০৯ সালে। তবে পথ চূড়ান্ত এবং নকশা প্রণয়নে ২ বছর ব্যয় হয়। থাইল্যান্ডভিত্তিক ইতালীয় থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে প্রথম নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষর হয় ১৯ জানুয়ারি ২০১১ সালে। এই বছর ৩০ এপ্রিল নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতালীয় থাই কোম্পানি পরে চীনের আরো দুটি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে। এটি থাইল্যান্ডভিত্তিক ইতালীয় থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ৫১ শতাংশ, চীনের শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপের ৩৪ শতাংশ এবং সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডের ১৫ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরুর সময় ধরা হয় ২০২০ সালে। প্রকল্পটি ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উড়ালসড়কের নকশা বদল, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা, অর্থের সংস্থানসহ নানা জটিলতায় নির্মাণকাজ শেষ করার সময়সীমা পাঁচবার পিছিয়েছে। তবে প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। উড়ালসড়ক নির্মাণকাজের ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ বহন করছে থাইল্যান্ড ও চীনের তিনটি প্রতিষ্ঠান। বাকি ২৭ শতাংশ বহন করছে বাংলাদেশ। মূল নির্মাণকাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার বহন করছে এবং বাকিটা বহন করছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও পরামর্শকদের পেছনে ব্যয়ে আলাদা একটি প্রকল্প আছে, যার পুরোটাই ব্যয় করছে সরকার। বর্তমানে এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে দুটি প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। সূত্রে জানা যায়, নির্মাণ-পরবর্তী সাড়ে ২১ বছর উড়ালসড়কের টোল আদায় করে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগের টাকা তুলে নেবে। উড়ালসড়কের ১৩ বছরে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। প্রকৃত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। এই ব্যয়বৃদ্ধির মূল কারণ হলো নকশা পরিবর্তন। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, পুরান ঢাকা আগেভাগেই অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ হয়েছে। সেজন্য সড়ক প্রশস্ত সম্ভব নয়। তবে নতুন ঢাকা হিসেবে গড়ে ওঠা পূর্বাচল, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও ও ফার্মগেটের আশপাশের এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। মেট্রোরেলের পর এবার চালু হলো উড়ালসড়ক। আমরা মনে করি, এই উড়ালসড়ক যোগাযোগব্যবস্থার সহজীকরণ ও আধুনিকতার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। জনগণের বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের উড়ালসড়ক একদিকে যেমন যানজট কমাবে, তেমনি অন্যদিকে আমাদের সময়ও বাঁচবে অনেক। পাশাপাশি আমাদের দেশের অর্থনীতিতে রাখবে উন্নয়নের বিরাট অবদান। বাংলাদেশের উন্নয়ন বর্তমানে যেভাবে দিন দিন বাড়ছে, তাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশটাকে তুলনা করলে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। আমরাও চাই, বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাক- বিশ্ব দরবারে দাঁড়াক মাথা উঁচু করে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত