দিন দিন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভূমিকম্পের ঘটনা বেড়েই চলছে। সম্প্রতি ৩ নভেম্বর শুক্রবার রাত ১১টা ৪৭ মিনিটে পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালের জাজারকোট জেলায় ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয় ও বিস্তার লাভ করে। গণমাধ্যমের খবরে এসেছে গভীর রাতের সেই ভূমিকম্পের ঘটনায় ৪ নভেম্বর পর্যন্ত নেপালে ৬ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্পে ১৩২ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যাও ১৪০ জন ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে নেপালের প্রশাসন। নেপালের ভূকম্পনের অভিঘাত এতটাই ছিল যে, তার প্রভাবে কেঁপে উঠেছিল সুদূর দিল্লির মাটিও। বেশ কিছুক্ষণ ধরে টের পাওয়া গিয়েছিল কম্পন। এছাড়াও ভূমিকম্পের কারণে এনসিআর, অযোধ্যাসহ উত্তর ভারতের বড় অংশের মাটিতে কম্পন অনুভূত হয়েছিল। গত শনিবার ভোর পর্যন্ত ভূমিকম্পে নেপালের জাজারকোট ও পশ্চিম রুকম প্রদেশে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত এবং বহু অঞ্চল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এই নিয়ে গত এক মাসের মধ্যে তিনবার কেঁপে উঠল প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল। গত মাসে ২২ অক্টোবরও কাঠমা-ু উপত্যকা ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। তখন ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ২০১৫ সালে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে নেপালে। সে সময় প্রায় ৯ হাজার মানুষ মারা যায়। আহত হয় ২২ হাজারের বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত হয় অন্তত ৫ লাখ স্থাপনা।
এ বছরের শুরুর দিকে তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখ একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প গাজিয়ানতেপ শহর থেকে পশ্চিমে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে স্থানীয় সময় রাত ৪:১৭ মিনিটে আঘাত হানে, যার ফলে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। সর্বোচ্চ নবম (প্রচণ্ড) মার্কেলি তীব্রতা ও ৭.৮ এম মাত্রার এই ভূমিকম্পটি ১৯৩৯ এরজিনজান ভূমিকম্পের সঙ্গে এটি তুরস্কের ইতিহাসের জ্ঞাত সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। ভূমিকম্পটি যখন আঘাত হানে বেশিরভাগ মানুষ তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বহুতল ভবন ধসে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর। মোমের মতো ধসে পড়েছে একাধিক ভবন। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ার বিস্তৃত এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। মিসর, লেবানন ও সাইপ্রাস থেকেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। ভূমিকম্পে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ছয় হাজার ভবন ধসে পড়েছে বলে জানান তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ পর্যন্ত গণমাধ্যমের খবরে আসে তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। দুই দেশে মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৫১ জনে। আরো অসংখ্য লোক এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকায় সংখ্যাটি আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চাপা পড়া লোকদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা এখন বেশ ক্ষীণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও বলছে, দুই দেশ মিলিয়ে, তাদের হিসাব অনুযায়ী, দুই কোটি ৩০ লাখ মানুষ ভূকম্পের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ১০ লাক্ষেরও বেশি শিশু রয়েছে বলে ডব্লিউএইচওর সিনিয়র জরুরি কর্মকর্তা অ্যাডেলহেইড মার্শাং এর আগে জাতিসংঘ স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী কমিটিকে জানিয়েছেন। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, জাপানের উপকূলে ২০১১ সালে ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল যার কারণে সেখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, এর কারণে সুনামি হয়েছিল এবং উপকূলের কাছে থাকা একটি পারমাণবিক কেন্দ্রে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পটি রেকর্ড করা হয়েছে ১৯৬০ সালে চিলিতে। সেখানে ৯.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল আর সাম্প্রতিক তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭.৮। এ ভূমিকম্পের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি বা প্রাণহানি দেখে বিশ্বের মানুষ যেখানে বিষ্মিত হয়েছে সেখানে আমাদেরও বিষ্মিত না হওয়ার কোনো কারণ নেই। ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় নাগরিকদের মৃত্যুতে এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। গত ৯ ফেব্রুয়ারি এটি পালন করা হয়। রাষ্ট্রীয় শোক পালন করলেই কি আমাদের সব দায়-দায়িত্ব শেষ, নিশ্চয়ই না। আমাদের এ বিপদের ভয়াবহতা দেখে আরো সতর্ক হতে হবে। আমরাও ঝুঁকির বাইরে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও। বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় থাকা রাজধানী ঢাকা এমন দুর্যোগ সামলাতে কতটা প্রস্তুত সেটাই বড় প্রশ্ন। ৫ নভেম্বর, ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী, রাজধানী ঢাকা শহরে প্রায় ১৫০০টি সুউচ্চ ভবন নিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে এ শহর। বর্তমানে এ সংখ্যাটি হয়তোবা আরো বেড়ে গেছে। রয়েছে আরো অনেক নির্মাণাধীন ভবন। ঢাকা পরিকল্পিত নগরায়ন নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকের মতে। এত অল্প জায়গায় এত বড়-ছোট বিল্ডিং ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য নগরীতে পরিণত হচ্ছে। ঘনবসতির এই শহরটির ঝুঁকি কমাতে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও এর বেশিরভাগই আলোর মুখ দেখেনি। আর্থ অবজারভেটরি সেন্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত, ইউরোপিয়ান ও মিয়ানমার এই তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। যেসব প্লেট কয়েকশ’ বছর ধরে শক্তি সঞ্চয় করছে। ফলে এখানে যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা হতে পারে ৮। মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে সারা দেশ। গত ১৫ বছরে ছোট বড় ভূমিকম্পে ১৪১ বার কেঁপে ওঠে দেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট ভূকম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বড় ভূমিকম্পের শতবছরের মধ্যে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়। সে হিসাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রকট। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বহু পুরোনো ভবন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করায় ভূমিকম্প ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, ভারতের আসামে ১৮৯৭ সালে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প আঘাত হানলে ২৫০ কিলোমিটার দূরে ঢাকার ১০ ভাগ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামালের গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের ৩০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৩৫ শতাংশ মূলত লাল মাটি। বাকি ৬৫ শতাংশ এলাকা নরম কাদামাটি ও বালুমাটি এলাকা। ৫-৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ঢাকার নরম মাটিতে তৈরি এসব ভবন ভেঙে বা হেলে পড়তে পারে।
২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি-সিডিএমপি ও জাইকার যৌথ জরিপে জানা গেছে, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫৭টি ভূমিকম্পের প্রভাবে কেঁপেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ২ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের ভূমিকম্পে কাঁপে দেশ। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ২ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল বঙ্গোপসাগর। ২০২১ সালের ২৯ মে এক দিনেই টানা ছয় দফা মৃদু ভূমিকম্পের কারণে সিলেট শহরসহ আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এসব কম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট, ময়মনসিংহ এবং রংপুর, ঢাকা, কুমিল্লা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু অংশ। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের চারটি জেলা বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। একইভাবে ময়মনসিংহ বিভাগের পাঁচটি জেলাও ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঢাকা বিভাগের মধ্যে টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদী জেলার অংশ বিশেষ, পুরো কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার উত্তরাংশ। মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের অংশবিশেষ, চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলা। ভূমিকম্পের কম ঝুঁকিতে রয়েছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পুরো খুলনা ও বরিশাল বিভাগ। প্রতিবারই বড় কোনো ভূমিকম্প হওয়ার পরই ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়, যা ধামাচাপা পড়ে থাকে বড় ধরনের আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানার আগ পর্যন্ত। এখনি ভূমিকম্পের সতর্কতা অবলম্বনে পরিকল্পিত নগরায়নসহ সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।