পোশাকশিল্পে অস্থিরতা কাম্য নয়

জালাল উদ্দিন ওমর

প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পোশাক এদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত, অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। এ খাতকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থানের বিশাল একটি বাজার গড়ে উঠেছে। অথচ, এই পোশাকশিল্পে কিছুদিন পর পর অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কখনো শ্রমিকরা তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ করে, আবার কখনো বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে কারখানায় হামলা করে এবং মূল্যবান জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। এই অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা এদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান এই খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ খাতে সরাসরি কর্মরত আছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। এ খাতকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে অনেক ব্যাকওয়ার্ড শিল্পকারখানা এবং এ খাতই দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রেখেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এত গুরুত্বপূর্ণ খাতটি এখনো অস্থিরতামুক্ত হয়নি। এই অস্থিরতার কারণে এর মধ্যেই অনেক পোশাকশিল্প-কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। একইভাবে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের কারণে অনেক কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিনিয়োগকারীরা নতুন কোনো শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করবে না এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এদেশে বিনিয়োগ করবে না। ফলে বিনিয়োগ ক্ষেত্রে সৃষ্টি হবে নতুন এক ধরনের স্থবিরতা, যা দেশের বিকাশমান অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করবে। প্রত্যেক বিনিয়োগকারী চায় তার কারখানায় উৎপাদনের নিশ্চয়তা, চায় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা। একই সঙ্গে তার বিনিয়োগকৃত অর্থের রিটার্নের নিশ্চয়তাও চায়। এছাড়া বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং তাদের কাজের অর্ডার অন্য দেশে চলে যাবে। উৎপাদনের পরিবেশ এবং কারখানার নিরাপত্তা যদি বিঘ্নিত হয়, তাহলে তো কোনো বিনিয়োগকারীই শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে এগিয়ে আসবে না। বিগত শতকের আশির দশক থেকে এদেশে পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর পর থেকে তা শুধু বিকশিতই হয়েছে। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই এই খাত থেকে আসছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার। তার মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পের একক অবদান ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলার। শতকরা হিসাবে যার পরিমাণ ৮১.৮২ শতাংশ। একইভাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলার। তার মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পের একক অবদান ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার। শতকরা হিসাবে যার পরিমাণ ৮৪.৫৭ শতাংশ। টোটাল রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৬৭ শতাংশ আর পোশাক খাতে এককভাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০.২৭ শতাংশ।

সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাকশিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো অবস্থান সৃষ্টি করেছে। এমনকি ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কোটামুক্ত প্রতিযোগিতার বাজারেও এই শিল্পের বিকাশ অব্যাহত রয়েছে। বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারী এমনকি বিশ্ববিখ্যাত অনেক পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এদেশে পোশাকশিল্প স্থাপন করেছে। অথচ, এই পোশাকশিল্পে মাঝেমধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। এই অস্থিরতার কারণ সম্পর্কে কেউ বলে ষড়যন্ত্র, কেউ বলে শ্রমিক অসন্তোষ। পোশাকশিল্পের মালিকরা শ্রমিকদের ওপর শোষণ ও বঞ্চনা চালালে, তার প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিকদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই শ্রমিক অসন্তোষকে পুঁজি করে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। সুতরাং শ্রমিক অসন্তোষই পোশাক শিল্পে অস্থিরতার মূল কারণ। তাই এর আসল কারণকে আগে চিহ্নিত করতে হবে এবং তা সমাধানের কার্যকর ও বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া বিকল্প যত পথই খুঁজি না কেন তাতে সমাধান আসবে না। কারণ, জোর করে শ্রমিকদের দিয়ে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়। শিল্পকারখানা পরিচালনা করতে মালিকদের প্রয়োজন শ্রমিকদের সমর্থন। মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক থাকলে পোশাকশিল্পে হামলা-ভাঙচুর, বিক্ষোভ আর নৈরাজ্য হবে না এবং উৎপাদনও ব্যাহত হবে না। বরং যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় শ্রমিকরা পোশাকশিল্পকে রক্ষায় এগিয়ে আসবে এবং মালিকের পাশে দাঁড়াবে। মালিক ও শ্রমিক একে অপরের প্রতিপক্ষ হলে কোনো প্রতিষ্ঠানই সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। অতএব, পোশাকশিল্পের অস্থিরতা ও বিপর্যয় বন্ধ করতে হলে প্রথমেই শ্রমিকদের প্রতি আন্তরিক হতে হবে, শ্রমিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই শুধু পোশাকশিল্পসহ যে কোনো শিল্পে সফলতা আসতে পারে। পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বেশ কিছু দাবি রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে চাকরির নিয়োগপত্র প্রদান, নির্দিষ্ট সময়ে বেতন প্রদান, ওভারটাইমের টাকা প্রদান, সাপ্তাহিক ছুটি প্রদান, ন্যূনতম মজুরি প্রদান, মহিলাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এবং কথায় কথায় চাকরিচ্যুত বন্ধ করা। পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের দাবিগুলো ন্যূনতম, মানবিক এবং মৌলিক অধিকার। একজন শ্রমিককে যদি ন্যূনতম বেতন প্রদান করা না হয়, তাহলে সে চলবে কী করে? পোশাকশিল্পের মালিকরা হয়তো বলবেন, তারা যে বেতন দেয় তাতে না পোষালে শ্রমিকরা চাকরিতে যোগদান করে কেন? বাস্তবতা হলো, যখন ক্ষুধা লাগে, সংসারে যখন অভাব থাকে তখন;কিন্তু যা পায় তাই গ্রহণ করতে একজন মানুষ বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে তার দর কষাকষির কোনো সুযোগ থাকে না এবং এটা সম্ভবও নয়। এটা যে কোনো মানুষের বেলায় সত্য। পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের শতকরা ৮০ ভাগই নারী। বলতে গেলে পুরো পোশাকশিল্পই দাঁড়িয়ে আছে নারীদের ওপর। মা হতে গেলে চাকরিটা হারাতে হবে এ ভয়ে পোশাকশিল্পে কর্মরত অনেক মহিলা মা হতে চায় না। তাছাড়া সামান্য কিছুতেই চাকরি চলে যাবার ভয়ে এ শিল্পের শ্রমিকরা সবসময় আতংকে থাকে। অনেক পোশাক কারখানায় পর্যাপ্ত টয়লেট নেই, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নেই, অগ্নি নিরোধক ব্যবস্থা নেই। আর এ অবস্থায় তো কোনো শ্রমিকের পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিকভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। আর এসব দাবি তো একজন শ্রমিকের যৌক্তিক, ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার। শ্রমিকদের প্রতি ভালো ব্যবহার, শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার দেয়া এবং মালিক-শ্রমিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা, ন্যায্য অধিকারের নামে শ্রমিকদের আকাশ কুসুম আবদার এবং দাবি চলবে না। ন্যায্য অধিকারের নামে শ্রমিকরা যদি অবাস্তব দাবি-দাওয়া করে, তাহলে তা তো মালিকদের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। সুতরাং শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া যুক্তিসঙ্গত, বাস্তবসম্মত এবং গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সরকার পোশাকশিল্পসহ সকল শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ইন্ডাস্ট্রি পুলিশ গঠন করেছে। এটা একটা ভালো উদ্যোগ কিন্তু সব সমস্যার সমাধান নয়। পুলিশ না হয় কারখানার নিরাপত্তা দিল, কিন্তু কারখানার মালিকের নিরাপত্তা দেবে কে? তার বাসায় নিরাপত্তা দেবে কে? তাকে রাস্তায় নিরাপত্তা দেবে কে? সুতরাং সকল ধরনের নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাস থেকে পোশাকশিল্পকে রক্ষা করতে হবে। পোশাকশিল্পের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধান করার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। এ কমিটি বিজেএমইএ’র নেতাদের সঙ্গে পোশাকশিল্পের সমস্যা দূরীকরণে যৌথভাবে কাজ করবে। একইভাবে পোশাকশিল্পকে মনিটরিং করার জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় গঠন করা হোক। তাহলে পোশাকশিল্পের সমস্যাগুলো দূর করাটা সহজ হবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক