প্রতিটি শিশুর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষাই যেকোনো জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। ব্যক্তি, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্য সর্বপ্রথম যে বিষয়টা প্রয়োজন তা হলো শিক্ষা। আর এই শিক্ষা অর্জনের মৌলিকভিত্তি তৈরি স্থান হলো প্রাথমিক শিক্ষা। যা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো থেকেই হাতে খড়ি হয়ে থাকে। আমরা শিক্ষিত সমাজের সবাই উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে থাকে অভিন্ন, সিলেবাস আর কারিকুলামের মাধ্যমে। কিন্তু জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে গিয়েই এই মানুষগুলো ব্যতিক্রমভাবে উপস্থাপন করে। জীবনের এই ব্যতিক্রমটা তৈরি যে মৌলিক ভূমিকা রাখে, তা হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাদের শিক্ষার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা কাজ ও শিক্ষা দেয়ার ব্যতিক্রমতার ফলাফলও ভবিষ্যৎ জীবনে ব্যতিক্রমতা তৈরি করে। সুতরাং একটি জাতিকে কীভাবে তৈরি করতে চায় তা নির্ভর করে প্রাথমিক শিক্ষার উপর। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকার ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের মাধ্যমে যুগান্তকারী পদক্ষেপ রাখেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেন। এছাড়া দেশের বিদ্যালয়বিহীন এলাকার ১ হাজার ৫০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব্যবস্থা, যেখানে ১৬ মিলিয়ন শিক্ষার্থী ও প্রায় ৪ লাখ শিক্ষক রয়েছেন। এ সব সরকারি উদ্যোগের ইতিবাচক প্রভাব পরেছে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন সূচকে। বার্ষিক প্রাথমিক শিক্ষা জরিপ ২০২১ অনুসারে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার ৯৯ শতাংশ এবং ঝরে পড়ার হার ১৪.১৫। তবে গুণগত শিক্ষা প্রদানে বাংলাদেশের অর্জন কতটুকু সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

শিক্ষার্থীকে জীবনযাপনের জন্য আবশ্যকীয় জ্ঞান, বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা, জীবন-দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, সামাজিক সচেতনতা অর্জন এবং পরবর্তী স্তরের শিক্ষা লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলাকে প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে স্থির করা। উপরন্তু বাংলাদেশ বর্তমানে জাতিসংঘ এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) অর্জনে কাজ করছে যার ৪ নম্বর অভীষ্টে রয়েছে গুণগত শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি, যে কোনো পরিবেশ খাপ খাওয়ানো কৌশল আয়ত্ত করা। একই অভীষ্টে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগের কথা বলা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ২০২২ পর্যালোচনা করলে প্রাথমিক শিক্ষায় মানের একটা হতাশাব্যাঞ্জক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ জরিপে এসেছে বাংলাদেশের ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী বাংলাই পড়তে পারে না। ইংরেজি ও গণিতে দুর্বলতা তার চাইতেও বেশি। দেখা যায় তৃতীয় শ্রেণির ৬০ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০ শতাংশ গণিতে কাঙ্ক্ষিত অর্জন করতে পারেনি। এসব অর্জনের আবার ভৌগলিক অঞ্চল ভেদে ভিন্নতা হয়েছে। আছে স্কুলের ধরনভেদে ভিন্নতা। আবার একই বিদ্যালয়ে সব শিক্ষার্থীর অর্জন সমান হয়। গুণগত মান বৈষম্যের কারণ মোটাদাগে চিহ্নিত করা যায় এভাবে : শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা কম, শিশুবান্ধব অবকাঠামোর অভাব, শিক্ষকদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও পেশাদারিত্বের অভাব, আনন্দহীন শিক্ষার পরিবেশ, বিদ্যালয়ে পাঠাগার ও হাতে-কলমে শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য ও অভিভাবকদের আন্তরিকতার অভাব ইত্যাদি। দেশের প্রাথমিক শিক্ষা বহুধারায় বিভক্ত। একই কারিকুলাম ও একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কথা জাতীয় শিক্ষানীতিতে ব্যক্ত হলেও এ ব্যাপারে অগ্রগতি সামান্যই। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাইরে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ৩০ হাজার। এসবের মধ্যে রয়েছে, বেসরকারি স্কুল তথা কিন্ডারগার্টেন, এবতেদায়ী মাদ্রাসা, এনজিও পরিচালিত স্কুল ইত্যাদি। এদের বেশির ভাগের অবস্থান শহর ও শহরতলিতে। অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ এসব বেসরকারি স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনের উদ্যোক্তা। শহরের এমনকি গ্রামের স্বচ্ছল অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এসব বেসরকারি স্কুলে পাঠিয়ে থাকেন। তবে নিম্নবিত্তের মানুষের সন্তানের জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই একান্ত গন্তব্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মিত হলেও দেখা যায় স্কুলে যাতায়াতের সড়কটির বেহাল দশা থাকাতে নতুন অবকাঠামোর পরিপূর্ণ উপকারিতা পাওয়া যাচ্ছে না। উপকূলীয় এলাকা ও চরাঞ্চলে এ সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারে না। ফলে তাদের লার্নিং লস হয়। চর এবং দুর্গম এলাকায় শিক্ষক ধরে রাখা আরেকটি সাধারণ সমস্যা। নিয়মিত শিক্ষকের পরিবর্তে প্রক্সি শিক্ষক ব্যবহারের বিষয়টি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে শিক্ষক নিয়োগের সময় বিশেষ শর্ত ও নিয়োগের পরে ফলাফলভিত্তিক বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্থানীয় বাস্তবতার আলোকে উত্তম চর্চা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত শিখন ফল অর্জনের চেষ্টা করা যেতে পারে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠ, ক্রীড়া, খেলাধুলা ও শরীরচর্চার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু দেখা যায় একটা বড় সংখ্যক বিদ্যালয়ের মাঠ নেই।

অনেক বিদ্যালয়ের কাগজে কলমে মাঠ থাকলেও বাস্তবে তা বেদখল হয়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রে মাঠ পুরো বর্ষা মৌসুমে খেলার অযোগ্য হয়ে থাকে। পাঠদানকে আনন্দময় না করতে পারলে কাঙ্ক্ষিত মান অধরা থেকে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অপরদিকে দারিদ্র্যতাকে শিক্ষণ ফল অর্জনে একটা বাঁধা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আমিষ ও ক্যালরির চাহিদা পূরণ না হলে একজন শিশুর মানসিক ও শাররীক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয় । অপুষ্টি ও ক্ষুধার কারণে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারে না। প্রত্যাশা অনুযায়ী শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। বাংলাদেশে ২০২২ পর্যন্ত নির্বাচিত কিছু বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালু ছিল যা স্কুলে উপস্থিতি ও ঝরে পড়া রোধে সহায়ক বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। সরকার বর্তমানে সব বিদ্যালয়ে মীড ডে মিল চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইন্টারনেট ও মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠদানকে আনন্দময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা যায়। সরকার সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ও প্রোজেক্টর বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায় শিক্ষকদের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে ও মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারে অনাগ্রহ বিদ্যমান। বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় বেশিরভাগ ডিজিটাল সরঞ্জাম অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। শিক্ষকদের সম্মান ও সুযোগের অভাবের কথা বিভিন্ন সময় আলোচিত হয়। শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়লে মেধাবীরা এ খাতে আসতে আগ্রহী হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব দৃশ্যমান। অনেকে প্রশিক্ষণ পেলেও তা বিষয়ভিত্তিক নয়। যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনার এর মাধ্যমে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বাইরে প্রাইভেট টিউটরিংকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। বেশিরভাগ স্কুলে ম্যানেজিং কমিটি থাকলে শিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষণ অগ্রগতি মূল্যায়নে তাদের অংশগ্রহণ কম।

এক্ষেত্রে তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যেতে পারে। শিক্ষা কার্যক্রমে নতুনত্ব ও সৃজনশীলতা আনতে স্থানীয় এনজিও, মিডিয়া ও শিক্ষা গবেষকদের যুক্ত করা যেতে পারে। বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও শিক্ষা উপকরণের বিষয়ে স্থানীয় অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এক দশক আগেও বাংলাদেশে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীর হার ছিল খুব কম এবং মেয়েদের হার ছিল আরো কম। শহরে স্কুলগামীর সংখ্যা কিছুটা বেশি হলেও গ্রাম-গঞ্জে যা ছিল একেবারেই কম। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে যেমন শতভাগ উপস্থিতি প্রদান, অভিভাবকদের সচেতন করতে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ, শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা, সময়মতো বই বিতরণ, বিনা বেতনে শিক্ষা, ফ্রি টিফিনের ব্যবস্থা, বাল্যবিবাহ রোধ প্রভৃতি কারণে স্কুলগামী ছেলেমেয়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি শিক্ষার হারও প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। দুঃখের ব্যাপার হলো- শিক্ষার হার বাড়াসহ শিক্ষিত সমাজের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেলেও আমরা তাদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে- তাদের মাঝে দেশপ্রেম জাগ্রত করে দিতে পারছি না। শিক্ষার পাশাপাশি ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য বুঝিয়ে নিজের জীবনে তা বাস্তবায়নের কতটুকু প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করাতে পেরেছি? ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, তাদের শিশু-কিশোররা প্রাথমিক জীবনে যা অর্জন করে আমরা প্রাথমিক পর্যায়েও তা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। কারণ মূলভিত্তি তৈরির স্থান হলো- প্রাথমিক শিক্ষকের ব্যবস্থা সেখানেই তা আমরা নয়-ছয় দিয়ে পার করে তাদের পরবর্তী সময়ের জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। পৃথিবীর সমৃদ্ধ দেশগুলোতে একজন কিশোর তার টিন এইজ বয়স থেকে কর্মমুখী হয়ে নিজে স্বাবলম্বী হয়, আর দেশের জন্য নিজেকে সর্ব্বোচ্চ প্রস্তুত করে রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষার হার যত বাড়ছে, বেকারত্ব ততই গ্রাস করছে।

তা ছাড়া শিক্ষার গুরুত্ব বা সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে চিন্তা করার মতো কল্পনা শক্তিও তাদের নেই। শুধু সিলেবাসভুক্ত পড়াশোনা না করিয়ে আদর্শভিত্তিক নীতি নৈতিকতা সম্পন্ন মানসিকতা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোপরি, সুস্থ, মেধা-বিকাশে শিক্ষার পরিবেশ তৈরির জন্য যা যা প্রয়োজন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য তা নিশ্চিত করতে হবে। বিনয়ী, সৎ ও যোগ্যতাসম্পন্ন একটি জাতি গঠনের জন্য যেসব অন্তরায় রয়েছে, সেগুলো অবশ্যই একদিন দূর হবে এবং যে স্বপ্ন-সাধ নিয়ে এই জাতির পথ চলা শুরু হয়েছিল তা অচিরেই পূর্ণ হবে। প্রাথমিক শিক্ষা একটি শিশুর জীবনে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও জ্ঞানার্জনের মূলভিত্তি তৈরি করে। সে কারণে, শারীরিক ও মানসিকভাবে সুসংগঠিত করে প্রগতিশীল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট সমাজ বিনির্মাণে সব শিশুর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। পরিশেষে বলব, উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হলে, প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক