পোশাক শ্রমিকরা কেন অবহেলিত বার বার

প্রদীপ সাহা, কলাম লেখক

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি জানায় আইবিসি (ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিল)। মজুরি বোর্ডের সভায় শ্রমিকদের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি দাবি করে প্রস্তাব দেন। কিন্তু মালিকপক্ষ তা ১০ হাজার ৪০০ টাকা দেবেন বলে জানায়। মালিকপক্ষ অনেক কম মজুরি প্রস্তাব করায় গত ২৩ অক্টোবর ২০২৩ গাজীপুরে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এরপর বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরির দাবিতে আন্দোলন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা। একাধিক কারখানায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো হয়। বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এতে দুজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়; প্রায় শতাধিক শ্রমিক আহত হয়। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে এ আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। অবশেষে গত ৪ নভেম্বর ২০২৩ মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে বন্ধ হওয়া অধিকাংশ পোশাক কারখানা খুলে। কিন্তু আন্দোলন পুরোপুরি থামেনি। কোথাও কোথাও শ্রমিকদের বিক্ষোভ চলছেই। পরিস্থিতি সামাল দিতে পাঁচ শতাধিক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকরা। ২০১৮ সালে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৮ হাজার টাকা। তখন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা। আর এখন ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ, ডলারের দাম হিসাব করলে আগের মজুরি বেড়ে হয় ১০ হাজার ৫৩৬ টাকা। এখন এর চেয়ে কম মজুরি প্রস্তাব করে মালিকপক্ষ। তারা ১১ হাজার টাকা বেশি প্রস্তাব করলেই শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের সান্ত¡না থাকত বলে মনে করা হয়। মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্যে গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া ও ঢাকার মিরপুরের প্রায় ২০০টি রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে মালিকপক্ষ। তাদের আশা ছিল, কারখানা খোলা রাখলে শ্রমিকদের বিক্ষোভ আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে। একটি হিসাব মতে, দেশে পোশাক কারখানা আছে ৯ হাজার ১৭৭টি। এসব কারখানায় ৪৩ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। বেশ কয়েক মাস ধরেই শ্রমিকরা মালিকদের কাছ থেকে একটি যৌক্তিক মজুরি প্রস্তাবের অপেক্ষায় ছিল। তা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তারা ২৩ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব করেন। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখেও মালিকরা যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা শ্রমিকদের ক্ষুব্ধ করে তোলে, যার ফলে তারা মাঠে নামতে বাধ্য হন। বর্তমান বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির স্রোতে হিমশিম খাচ্ছে জনগণ। হু হু করে বেড়েই চলেছে দ্রব্যমূল্যের দাম। এ অবস্থায় বর্তমান বাজার বিবেচনায় শ্রমিকদের চলার পথ অনেক কঠিন। কেউ আর আগের মতো অবস্থায় নেই। শুধু শ্রমিক কেন- কেউ ভালো নেই এই কঠিন সময়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সবার নাগালের বাইরে চলে গেছে। বর্তমান বাজারমূল্যে শ্রমিকরা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি অবশ্যই দেওয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন অনেকেই। যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়- জিডিপি বৃদ্ধি, দেশের উৎপাদন কাজ এবং রাস্তাঘাট কে নির্মাণ করে থাকে? সবাই খুব সহজে বলবে- শ্রমজীবী মানুষ। আর যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়- দেশের সবচেয়ে অবহেলিত, কম মজুরি পাওয়া, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা এবং মাথাপিছু আয় কাদের সবচেয়ে কম? সেখানেও সবাই মিলে একবাক্যে বলবে- শ্রমজীবী মানুষ। সত্যিকার অর্থে শ্রমিকরাই সবদিক দিয়ে বেশি অবহেলিত।

পোশাক খাতকে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হয়। কিন্তু এ পোশাকশিল্পেই দেখা যায়, যত অনিয়ম আর আন্দোলন। পোশাকশ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে সবসময়ই থাকে বঞ্চিত। বছরের পর বছর বিভিন্ন দিক দিয়ে তারা অবহেলিত হয়ে আসছে। পোশাকশ্রমিকরা যদি দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে তাদের জীবন নির্বাহ করতে চান, তাহলে ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি প্রয়োজন অথবা ন্যূনতম ১৫ হাজার টাকা থেকে আলোচনা শুরু করা উচিত। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বেশ চাপে আছেন দেশের সব মানুষ। তাই পোশাকশ্রমিকের মজুরি এমনভাবে বাড়াতে হবে, যাতে শিল্পও বেঁচে থাকে। শিল্প বাঁচলেই শ্রমিকরা বাঁচবেন। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে শ্রমিক ও শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের জন্য রেশনিংব্যবস্থা চালু করা দরকার। এই রেশনিং ব্যবস্থা চালু হলে শ্রমিকদের ওপর থেকে মূল্যস্ফীতির চাপ অনেকাংশে কমে যাবে বলে মনে করেন অভিজ্ঞমহল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক হিসাবে দেখা গেছে, একজন পুরুষ পোশাক শ্রমিকের দৈনিক ৩ হাজার ৩৬৪ কিলোগ্রাম ক্যালরি এবং নারী পোশাক শ্রমিকের দৈনিক ২ হাজার ৪০৬ কিলোগ্রাম ক্যালরি শক্তির প্রয়োজন হয়। অবশ্য নারী পোশাক শ্রমিকের ক্ষেত্রে কিলো ক্যালরি কিছুটা কম হলেও সন্তান প্রসবের সময় তা আবার বেশি প্রয়োজন হয়। পুষ্টিবিদদের মতে, একজন পোশাকশ্রমিক তার খাবারের ৫৭ ভাগ শর্করা জাতীয় খাবার (চাল, আটা ইত্যাদি), ৩০ ভাগ চর্বি জাতীয় খাবার (তেল, ঘি ইত্যাদি) এবং ১৩ ভাগ প্রোটিন জাতীয় খাবার (মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি) থেকে পূরণ করা উচিত। তাদের শরীরের জন্য ভিটামিনও খুব প্রয়োজন। একজন শ্রমিকের শরীরে যদি প্রয়োজনীয় কিলোগ্রাম ক্যালরি না থাকে, তবে সে কর্মক্ষম থাকতে পারবে না এবং ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে পড়বে। একজন পোশাক শ্রমিক প্রয়োজনীয় শক্তি ও পুষ্টি পূরণ করার জন্য যদি বাজারের নিম্নমানের খাবার খায়, তবে তার অবস্থা কী হবে- তা সহজেই অনুমেয়। সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার পর গত ৪ নভেম্বর ২০২৩ থেকে খুলে দেওয়া হয় সব পোশাক কারখানা। তবে কয়েকটি কারখানা খোলার পর সেখানে শ্রমিকরা গেলেও কাজে যোগ দেননি। আর শ্রমিক অসন্তোষের মুখে বন্ধ হওয়া ৪১টি কারখানা নানা কারণে খোলা সম্ভব হয়নি। গত ৭ নভেম্বর ২০২৩ সর্বশেষ নিম্নতম মজুরি নির্ধারিত হয় ১২ হাজার ৫০০ টাকা। বর্তমানের চেয়ে এ মজুরি ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। সহজ করে বলা যায়, গত ৫ বছরে পোশাকশ্রমিকের বেতন বাড়ল ৪ হাজার ৫০০ টাকা। নতুন এ মজুরি কার্যকর হবে ১ ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে। সিপিডির গবেষণা অনুযায়ী, বর্তমান বাজারমূল্যে এ বাড়তি মজুরিতে শ্রমিকদের প্রয়োজন মিটবে না। ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করে আবারো আন্দোলনে নেমেছেন পোশাকশ্রমিকরা। গত ৮ নভেম্বর ২০২৩ গাজীপুর মহানগরীর পাঁচটি স্থানে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কার্যত পদক্ষেপ নেয়। এ সময় একজন নারী পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। শ্রমিক বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনায় গাজীপুরের কোনাবাড়ী ও ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় ২৫টি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এভাবে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন আর কতকাল দেখব আমরা? আর কত মৃত্যু দেখতে হবে আমাদের? আর কত হয়রানি হতে হবে আমাদের রাস্তাঘাটে চলার পথে? পোশাক শ্রমিকদের মজুরি কম হওয়া মানে দেশের ক্ষতি হওয়া। কিন্তু মালিকপক্ষ এসব কথা শুনতেই চান না। শ্রমিকরা যখনই আন্দোলন করে, তখনই মালিকপক্ষ পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের দমন করার চেষ্টা করে। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি না দিয়ে যদি তাদের একের পর এক এভাবে দমন করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেই কারখানায় কখনোই শান্তি আসতে পারে না। তাই দেশ ও জাতির কল্যাণে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের সঠিকভাবে বাঁচার অধিকার দিতে হবে। যে পোশাক খাতকে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হয়, তাকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব যেমন মালিকপক্ষকে নিতে হবে, তেমনি সরকারেরও কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে।