নারী কিসে আটকায় ও বাস্তব প্রেক্ষাপট

মো. রায়হান আলী, অ্যাডভোকেট

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি খবর কিছুদিন আগে বেশ সরব হয়েছিল। নারী কিসে আটকায়! কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তার স্ত্রী সোভি গ্রেগয়ের ট্রুডোর আলাদা থাকার ঘোষণার পরই এই আলোচনাটি গণমাধ্যমের সামনে আসে। তাদের ১৮ বছরের দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত হওয়ার পর তিন সন্তানের এই পিতামাতা বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন না করে আলাদা থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। এ কারণেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থেকে শুরু করে ট্রল, মিম, পোস্ট ও পাল্টাপাল্টি মন্তব্যের ঝড়। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি পোস্টের বক্তব্য ছিল- ‘জাস্টিন ট্রুডোর ক্ষমতা, বিল গেটসের টাকা, হাকিমির জনপ্রিয়তা, হুমায়ুন ফরীদির ভালোবাসা, তাহসানের কণ্ঠ কিংবা হৃত্বিক রোশানের স্মার্টনেস। কোনো কিছুই নারীকে আটকাতে পারেনি, বলতে পারবেন নারী কিসে আটকায়?’

এই ফেসবুক পোস্টে যেসব পুরুষের নাম নেওয়া হয়েছে তারা সবাই স্বনামধন্য ও সর্বজন পরিচিত। তারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নন। তারা সবাই একে অপরের সাথে পারস্পরিক সমঝতার ভিত্তিতে তাদের সঙ্গী থেকে আলাদা হয়েছেন কিংবা বিচ্ছেদের পথ বেছে নিয়েছেন। দম্পতিদের পারস্পরিক সমঝতার মধ্যদিয়েই যদি এমন সিদ্ধান্ত আসে, তাহলে কেন নারী কিসে আটকায়? এমন প্রশ্ন গণমাধ্যমে। এটা অনেকেরই প্রশ্ন।

সংবিধানেও নারী-পুরুষের সমানাধিকার সম্পর্কে বলা আছে। সংবিধানের ১৯নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।’ ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার এবং ৪০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যোগ্যতার ভিত্তিতে পেশা বাছাইয়ের অধিকার নারী-পুরুষ উভয়ের রয়েছে।

প্রতিনিয়তই বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা। পত্রিকার খবরে রাজধানী ঢাকায় প্রতি ৪০ মিনিটে একজনের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে গত বছরে। এ বছর হয়তোবা সংখ্যাটা আরো বেশি হতে পারে। ইসলাম ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে যদি সব পথ অবলম্বন করেও ডিভোর্স থেকে নিজেকে সরানো সম্ভব না হয়, তবে তা অনুমতি আছে। এই ‘ডিভোর্স’ নামের বিষবৃক্ষটি যখন সামনে উপস্থিত হয়, তখন দাম্পত্যজীবনের সব আবেক হারিয়ে যায় মুহূর্তে। বিশেষ করে পছন্দের মানুষ, ভালোলাগার মানুষ, স্বপ্নের মানুষদের জীবনে এমন ঘটনা ঘটলে তা মেনে নেওয়া কঠিন হয়।

সংসার জীবনে সুখ-দুঃখের স্বপ্ন সারথীর মধ্যেই অতিবাহিত হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একে অপরকে বুঝে ছাড় দেওয়ার মানসিকতাই সংসারকে একটি সুখী সংসারে পরিণত করতে পারে। এটুকু ছাড় দেওয়ার মানসিকতা যে সংসারগুলোতে নেই সেই সম্পর্কগুলোই আজ ডিভোর্সের দিকে বেশি এগোচ্ছে। বর্তমানে ডিভোর্সের নানান কারণ সমাজে পরিলক্ষিত হয়। যেমন- অসম বিয়ে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্মানবোধের অভাব, প্রতারণা, উচ্চাভিলাষী, পরকীয়া, যৌতুক, সম্পর্কের টানাপড়েন, স্ত্রীর সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা না থাকা ইত্যাদির কারণে ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা যেসব ধারণা পোষণ করছেন তা হলো- মেয়ের মা-বাবার কুপরামর্শ, স্বামীর সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করা, স্বামীর অবাধ্য চলাফেরা করা, স্বামীকে যথেষ্ট সম্মান না করা, ছেলে বন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা, মেয়ের মা-বাবা, মেয়ের জামাইয়ের সংসারে খবরদারি করা, স্বামীর সেবা না করা, স্বামীর মা-বাবাকে নিজের মা-বাবার মতো মনে না করে, তাদের প্রতি অপ্রীতিকর অশোভন আচরণ করা ও তাদের দেখভাল না করা, স্বামীর অনুমতি ছাড়া এখানে ওখানে চলে যাওয়া ইত্যাদি। বর্তমানে বিবাহ বিচ্ছেদ বা ডিভোর্স যেন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে! এত বড় কঠিন একটা সিদ্ধান্তকে অনেকেই কিছুই মনে করছে না। খুব ছোটোখাটো বিষয় নিয়েও বিবাহ বিচ্ছেদের মতো কঠিন সিদ্ধান্তটা দম্পতিরা সহজেই নিচ্ছে। মনে হচ্ছে এটা ডাল-ভাতের মতোই সহজ! আসলে এই ডিভোর্স সহজের পেছনে বর্তমান সমাজের কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনাও এটাকে উদ্বুদ্ধ করছে। সমাজ ও সামাজিকতা যুগ যুগ ধরেই এর আগের রীতিনীতি অনুসরণীয়। একটি যুবসমাজ সাধারণত এই সমাজের এলিট পারসন যুবসমাজ কী করছে, সেটা সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করে। হোক সেটা পোশাক-আশাকের, চলনে-বলনের, কোনো কর্মের বা নতুন কিছু আপডেট কালচারের ইত্যাদির। অনেক ছোটোখাটো পারিবারিক সমস্যাতেই ডিভোর্সের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত সহজেই নিচ্ছে অনেকে। ডিভোর্স বিবাহিত নারী কিংবা পুরুষ উভয় এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সাধারণত ডিভোর্স হওয়ার পর পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি সমস্যার সম্মুখীন হন। ডিভোর্সি নারী পরবর্তীতে নতুন করে বিয়ে করা কিংবা পিত্রালয়ে অবস্থান করাসহ আরো যদি সন্তানাদি সঙ্গে করে নিয়ে আসে, তাহলে তো বিপদের ইয়ত্তা নেই। পিত্রালয়ে ওই নারীর নতুন করে জীবনযুদ্ধ শুরু হয়।

অনেক ডিভোর্সি নারী হয়তোবা স্বামী-সংসার, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে ডিভোর্সের পথ বেঁচে নিয়েছেন। সেই নারী এখন পিতার বাড়িতে যে কত সুখে বা যন্ত্রণায় আছে, তা ওই নারীর বাস্তব জীবনই বলে দেবে! হয়তোবা এমন অনেক নারী আছেন, তারা ডিভোর্স-পূর্ববর্তী স্বামীর বাড়ির কষ্টের চেয়ে বর্তমান পিতার বাড়িতে আরো কষ্টে আছেন। নেই সামাজিক মর্যাদা, পদে পদে সমাজ, পিতামাতা, আত্মীয়স্বজনদের কাছে প্রতিনিয়তই হেয় প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে। হয়তোবা ওই নারীটি স্বামীর সংসারে একগুণ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ডিভোর্স নিয়েছেন, এখন পিতার বাড়িতে ফিরে এসে দেখে এখানে কষ্ট আরো কয়েকগুণ বেশি! গোদের উপর বিষের ফোঁড়া! সমাজে যেন মুখ দেখানোর জায়গা পায় না অনেকে। কেউ কেউ নীরবে-নিভৃতে পিতার বাড়িতে ডুকরে কাঁদে। অনেকে তো জীবনের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে বাকি জীবন পিতা বা ভাইদের আশ্রয়ে সমাজের অবহেলিত একজন ব্যক্তি হিসেবে মানতে না পেরে নিজের জীবনকে আত্মাহুতি দিয়েও থাকেন। সুন্দর সাজানো-গোছানো জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে অনেকের। কারো জীবনে এমন অঘটন ঘটে গেলে ধৈর্য ধরে জীবনটাকে নতুন করে সাজানোর জন্য প্রাণন্তর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। জীবনের কাছে পরাজিত হয়ে নিরুৎসাহিত হয়ে ভেঙে পড়লে চলবে না। আরো কঠিন করে জীবনের চলার পথটাকে সুক্ষ্মভাবে পরিচালনার জন্য তৈরি করতে হবে। আজ অবধি সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছে যারা পদে পদে শুরুতে বিফল ছিল, জীবনে হোঁচট খেয়েছিল। ইতিহাসের বর্ণবাদী নেতা ল্যানসন ম্যান্ডেলা ২৭ বছর জেলে থাকার পরও রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরে পেয়েছেন। ধৈর্য ও সাহসিকতা, বিচক্ষণতা, কর্ম মানুষকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যায়। বিপদ আসতে পারে, তাই বলে বিপদকে ভয় করে পেছনে না হটে শক্ত হাতে মনোবল ঠিক করে সামনে এগিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

২০২২ সালে প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী ও অভিনেত্রী মেগান মার্কেলের পডকাস্টে অংশ নেন সোফি ট্রুডো। তাদের আলাপে উঠে আসে নারীর প্রতি প্রত্যাশার কথা; আর কীভাবে খোদ নারীরাই নিজেদের ওপর এই প্রত্যাশার বোঝা চাপান- উঠে আসে সে কথাও। সোফি বলেন, একজন নারীকে বহু ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। এ সময় বিষয়টির এর ব্যাখ্যাও দেন সোফি, ‘বিশ্বজুড়ে নারীরা এখনো পরিবারের প্রাণকেন্দ্র। নারীরা সর্বংসহা। কিছু ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া বেশিরভাগ নারীই সব কূল-প্রতিকূল অবস্থা সহ্য করে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। আটকাতে চায় না নিজেকে কোনো কিছুর ধূম্রজালে। প্রগতির ধারা বজায় রেখেই সামাজিকভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চায় সর্বমহলে। নারীরা যদি কোনো কিছুতে আটকায়, তা হলো কোনো কারণে সহ্যের সীমা অতিক্রম ঘটলে আর বিবেকের কাঠগড়ায়। আসলে হয়তোবা নারী আটকায় পুরুষের যত্নে, ব্যবহারে, দায়িত্বে ও সম্মানে। নারী মায়ের জাতি, তাই নারীকে সম্মান-শ্রদ্ধা আর প্রকারভেদে ভালোবাসায় আটকানো উচিত।