বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং বিপর্যয়

সম্মানের খাতিরে দায়িত্বশীল হওয়া দরকার

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এশিয়ার সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নাম। যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াক কোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিং ২০২৪-এ শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। এবারের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১৪০তম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া তালিকার শীর্ষ ২০০ প্রতিষ্ঠানের মধ্য রয়েছে বুয়েট ও বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় দুটির অবস্থান যথাক্রমে ১৮৭তম ও ১৯১তম। সম্প্রতি এশিয়ার সেরা ৮৫৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াক কোয়ারেলি সায়মন্ডস। প্রতি বছরের নভেম্বরের শুরুতে এ তালিকা প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে, এশিয়ার সেরা ৮৫৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এবারও সবার সেরা হয়েছে চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি (বেইজিং)। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। এ র‌্যাঙ্কিং প্রধানত ১১টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এরই মধ্যে একাডেমিক কার্যক্রম, পিএইচডিধারী কর্মী ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিবেচনা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে করা র‌্যাঙ্কিংয়ের বিষয়ে অন্যতম একটি হলো- কিউএস ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিং। কিউএস প্রতি বছর কয়েকটি মানদ-ের ভিত্তিতে বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক একটি র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা, উদ্ভাবন, চাকরিতে স্নাতকদের কর্মক্ষমতা, প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাফল্য, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক, গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশন, পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সংখ্যা, আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনুপাত, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী বিনিময়ের হার বিচার করেই এ তালিকা করা হয়। এর আগে গত সেপ্টেম্বর মাসে আরো দুটি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করে।

সেখানে স্পেনের মাদ্রিদভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েবমেট্রিক্সের করা র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ ১০০০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। ৩১ হাজার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে করা এ র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল যৌথভাবে ১০৫১তম। আর বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ১৪২১তম। যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ (টিএইচই) বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছিল সেখানে তালিকায় শীর্ষ ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভারতের ২৪টি ও পাকিস্তানের ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিল। ওই তালিকায় ৮০০-এর পর বাংলাদেশের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায়। যেখানে র‌্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে ছিল বাংলাদেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলো হলো- ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। এছাড়া ওই র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায় ১০০১-১২০০-এর মধ্যে। ১২০১-১৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে ২০২২ সালে টাইমস হায়ার এডুকেশনের র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০১ থেকে ৮০০-এর মধ্যে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এসব প্রতিষ্ঠানের র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা যদি এমনি হয়, তাহলে সেটা আত্মসম্মানের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান কেমন, তা এসব র‌্যাকিংয়ের মাধ্যমে ফুটে উঠে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই বিপর্যয় কোনো অবস্থায় মেনে নেয়া যায় না। এর পেছনের কারণ কী হতে পারে, তা খুঁজে বের করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত মানের শিক্ষক বেছে নেয়া সম্ভব হয় না। ক্লাসে ভালো শিক্ষক পাওয়া না গেলে, ভালো ছাত্র গড়ে উঠবে না। একজন ভালো শিক্ষকই পারেন ছাত্রদের মধ্যে মেধার পরিস্ফূরণ ঘটাতে। তবে আমাদের দেশের বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক শিক্ষাদানকে পেশা হিসেবে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারছেন না। এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, আর্থিক বিষয়সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাব। শিক্ষকতা করতে গিয়ে যদি সংসার পরিচালনার জন্য অন্য কাজে মনোনিবেশ করতে হয়, তাহলে সেই শিক্ষকের পক্ষে পাঠদানে মনোযোগী হওয়া সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা অধ্যাপনা করেন, তাদের বেতন-ভাতা সেইভাবে নির্ধারণ করা দরকার, যাতে তার সংসার পরিচলনা করার জন্য তাদের অন্যদিকে মনোযোগ দিতে না হয়। আর্থিক সংকটাপন্ন অবস্থায় ভালো শিক্ষাদান করা বাস্তবিক অর্থেই কঠিন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‌্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে পড়ছে, এটা যেমন কাম্য হতে পারে না, তেমনি আমাদের দেশের শিক্ষকরা শিক্ষাদান ছাড়া অন্য কাজে মনোনিবেশ করবেন, সেটাও কাম্য নয়। তাই মানসম্মানের কথা বিবেচনা করে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে আরো দায়িত্বশীল ও সচেতন হতে হবে।