আইনের বিক্ষিপ্ত আচরণ

আরিফ আনজুম, কলাম লেখক

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এটা প্রতিটি স্বাধীন-সার্বভৌম সমাজ ব্যবস্থাপনায় লক্ষণীয় এবং প্রদীয়মান যে, প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্রে কিছু আইন প্রণয়ন ও রীতিনীতি চলমান থাকে। যাতে আমাদের দেশও এর বাইরে নয়, আমাদেরও প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মতো কিছু আইন রয়েছে সমাজ ব্যবস্থাপনায়। সমাজে অন্যায় ও অপরাধের প্রতিকারের জন্য রয়েছে আইন ও আদালত। আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আছে পুলিশ প্রশাসন। পুলিশ সন্দেহভাজন অপরাধীকে প্রয়োজনে গ্রেপ্তার করতে পারে। কিন্তু সেটিও আইন মেনেই করতে হয়। পুলিশ কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে পারে না। শাস্তি বা দণ্ড দিয়ে থাকে বিজ্ঞ আদালত। সেটি অবশ্যই তদন্ত ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে। সে কারণেই অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত একজন ব্যক্তিকে অপরাধী বলা যায় না। কিন্তু সমাজে ধৃত বক্তিকে চোর, ডাকাত, খুনি বলে অভিহিত করার অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এটি যে অসমীচীন, তা বলাইবাহুল্য। পুলিশ বা র‌্যাব অভিযান চালিয়ে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেই মিডিয়ার সামনে হাতকড়া পরিয়ে হাজির করে থাকে। এটিও প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে সমাজে। পুলিশ সন্দেহভাজন অপরাধী ধরবে। আইন অনুযায়ী আদালতের সামনে হাজির করবে। তদন্ত ও শুনানি, সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থিত করা থেকে শুরু করে সার্বিক বিচারিক কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আদালত তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে। এখানে প্রতিটি ব্যক্তিরই আইনসম্মত বা বিধিসম্মত দায়দায়িত্ব রয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কেউ আইনবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত হবে, সেটি প্রত্যাশীত নয়। দুঃখজনক হলো, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ২৬৭ ধারায় রিমান্ড ও গ্রেপ্তারে আদালতের নির্দেশনা ১৭ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে কিছু বিষয় উল্লিখিত হয়েছে, যা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য অবশ্যই ভাবনা ও বিবেচনার বিষয়। আদালতের নির্দেশনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, আসামি বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে (রিমান্ড) নিয়ে নির্যাতন করা যাবে না। পাশাপাশি গ্রেপ্তারের সময় ও স্থান এবং আটক রাখার জায়গা গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির স্বজনকে জানাতে হবে। সংবিধান অনুসারে সর্বোচ্চ আদালতের রায় বা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সবার জন্য বাধ্যতামূলক।

অথচ জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এমনকি রিমান্ডে নির্যাতনের ফলে অনেক সময় আটক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। এটি সভ্যতার অগ্রযাত্রা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কোনো প্রকার নির্যাতন করা যাবে না। রিমান্ড প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাঁচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন, যাতে নির্যাতন করা হচ্ছে কি না দেখা যায়। বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ১৬৭ ধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা করে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ। এ সংক্রান্ত হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে পূর্ণাঙ্গ রায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য ১০ দফার একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে আপিল বিভাগ। পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য ৯ দফা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালনের বিষয়েও সাত দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। বাস্তবে এসবই যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগসহ বিভিন্ন মামলাই তার প্রমাণ। অথচ গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করা হলে পুলিশের ভাবমূর্তি অনেকাংশে বেড়ে যেত। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিষয়টি হয়তো অস্বীকার করবেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। আমরা যদি বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই বহির্বিশ্বে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখায় প্রত্যয়ী দেশ হিসেবে মর্যাদায় দেখতে চাই, তাহলে এ বিষয়গুলো আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। আইনের মানুষ আইনসম্মত আচরণ করবেন, সেটিই প্রত্যাশিত। আমরা আমাদের আইনের প্রতি যত্মশীল হলে শ্রদ্ধাশীল হলে, অবশ্যই আইন ও আইনের পরিধি আমাদের জন্য উপযুক্ত হবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস করা যায়। আমজনতা যতটা খারাপ হবে, আইন তার সম্মানবোধ ততটা বাজেভাবে প্রয়োগ হবে। কারণ, আইন তো জনগণের জন্যই প্রযোজ্য, আর সেটা তো অপরাধের জন্যই কার্যকর করা হয়। আইনে যদি অপরাধী বেশি ক্ষিপ্ত হয়, তাহলে তো আইন আরো বেশি বিক্ষিপ্ত হবেই, আর এই বিক্ষিপ্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক।