আন্দোলনের মুখে পোশাক কারখানা বন্ধ

প্রশাসন ও মালিক পক্ষকে নিতে হবে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত

প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১৩০টি পোশাক কারখানার সব কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। তৈরি পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান গতকাল এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, পোশাক কারখানায় কর্মচারী ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং কারখানার সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে এসব কারখানার সব কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। উত্তরায় বিজিএমইএ অফিসে ‘পোশাক শিল্পে ন্যূনতম মজুরি ও বর্তমান শ্রম পরিস্থিতি’ বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান জানান, মজুরি বৃদ্ধির পরও আন্দোলনের নামে বিভিন্ন জায়গায় কারখানা ভাঙচুর করা হচ্ছে। মজুরি ঘোষণার পর থেকে বেশ কিছু কারখানায় অজ্ঞাতনামা কিছু উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিক অযৌক্তিক দাবিতে বেআইনিভাবে কর্মবিরতি পালন করে কর্মকর্তাদের মারধর করেছে। কারখানার ভেতরে ব্যাপক ভাঙচুর ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আশুলিয়া, কাশিমপুর, মিরপুর ও কোনাবাড়ি এলাকার প্রায় ১৩০টি পোশাক কারখানা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এসব কারখানার মালিকরা মূলত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং কারখানার সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে কারখানার সব বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেসব কারখানা শ্রমিকরা কাজ করতে আগ্রহী, সেগুলোতে কাজ চলছে। তাদের কাজ চলমান থাকবে। করোনা মহামারির কারণে দেশের মধ্যে ২০২০-২১ সালে বন্ধ হওয়া কারখানার সংখ্যা ৩১৭টি। আর করোনা-পরবর্তী সময়ে অন্যান্য কারণে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে না পারার কারণে ২৬০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এই শিল্পের উত্থানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বন্ধ কারখানার সংখ্যাও বাড়ছে। কারখানা বন্ধ হয়েছে নানা সংকটে।

এ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার ৮৮৫টি পোশাক কারখানা বিজিএমইএ-এর সদস্যপদ গ্রহণ করলেও কালের পরিক্রমায় ৩ হাজার ৯৬৪টি সদস্য কারখানা বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ সালে বন্ধ হওয়া কারখানার সংখ্যা ৩১৭টি এবং পরবর্তীতে অন্যান্য কারণে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে না পারার কারণে ২৬০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। ফারুক হাসান বলেন, শিল্পের অভ্যন্তরের গভীরতম সংকটের বিষয়টি গণমাধ্যমে সেভাবে প্রকাশিত উঠে আসছে না। কতখানি সংকটের মধ্যে থেকে, কতখানি অনিশ্চয়তা সঙ্গে নিয়ে কারখানাগুলো চলছে তা বন্ধ হওয়া কারখানার পরিসংখ্যানই বলে দেয়। কোনো উদ্যোক্তাই চান না, তার অক্লান্ত কষ্টে তিলে তিলে গড়া উঠা শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাক। কিন্তু বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কিছু বিষয় আছে, যার প্রভাব থেকে শিল্প চাইলেও বের হতে পারে না, শিল্পকে তা গ্রহণ করতেই হয়। এটাই এ শিল্পের কঠিন বাস্তবতা। অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমরা যখন ‘বৈশ্বিক ও আর্থিক’ এ দ্বিমুখী চাপের মধ্যে থেকেই টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছি, ঠিক তখন শিল্পকে নিয়ে শুরু হয়েছে নানা অপতৎপরতা। বিশেষ করে আমাদের শান্ত শ্রমিক গোষ্ঠীকে উসকানি দিয়ে অশান্ত করা হচ্ছে। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, মজুরি বৃদ্ধির পরও আন্দোলনের নামে বিভিন্ন জায়গায় কারখানা ভাঙচুর করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাগুলো এ ব্যাপারে আমাদের ভিডিও ফুটেজ দিয়েছে, মামলার কপিও আমাদের দিয়েছে। মজুরি বাড়ানোর পরও পোশাক শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনের জেরে সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই মিলে ওইসব পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শ্রমিক আন্দোলনের মুখে মালিক কর্তৃপক্ষ কারখানাগুলো বন্ধ করে দেয়। কারখানা বন্ধ করার কারণ হিসেবে মালিক কর্তৃপক্ষ জানায় কারখানার শ্রমিকরা কাজে আসার পর চলে যায় এবং বিভিন্ন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করতে থাকে, এমন অবস্থায় মালিক কর্তৃপক্ষ এসব কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য শ্রম আইনে ১৩ এর ১ ধারায় বন্ধ রাখে।

আশুলিয়ার টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের জামগড়া, নরশিংহপুর, ছয়তলা, জিরাবো এলাকার দুইপাশে থাকা পোশাক কারখানাগুলোর অধিকাংশই বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় মালিক কর্তৃপক্ষ। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের অভিঘাত-পরবর্তী পরিস্থিতি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের কারণে কার্যাদেশ কমে যাওয়া এবং সাম্প্রতিককালে শ্রমিক অসন্তোষ, কারখানার কাজ বন্ধ, শ্রমিক-কর্মচারীদের মারধর, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, মালামাল লুটপাট ইত্যাদি জটিল পরিস্থিতির কারণে গার্মেন্ট শিল্প আজ ঝুঁকির মুখে। পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে গঠিত মজুরি বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় সর্বনিম্ন মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা ধরে মোট ৫টি গ্রেডে মজুরি প্রস্তাব করে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। পরে সেই প্রস্তাবই গ্রহণ করা হয়। তবে তা প্রত্যাখ্যান করে সাভার, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ২৩ থেকে ২৫ হাজার টাকা মজুরি দাবি করা শ্রমিক সংগঠনগুলো। এই পরিস্থিতিতে মুজরি বাড়ানোর দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর অবরোধ কর্মসূচি। তার ওপর গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ কিংবা সাধারণ ছুটি দেয়ার ফলে সময়মতো ক্রয়াদেশ প্রতিপালন করা সম্ভব হচ্ছে না। গার্মেন্ট মালিকরা কোনোভাবে তাদের সংসার চালাতে পারলেও শ্রমিক কর্মচারীরা কীভাবে সংসার চালাবে, সেই চিন্তায় তারা বিভোর। কর্মস্থল বন্ধ থাকলে বেতন-ভাতা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চিয়তা থেকে যায়। নির্ধারিত সময়ে বেতন না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শিপমেন্ট হলে আয় আসবে। অর্থ না আসলে শ্রমিকদের বেতন হবে না। বেতন না পেলে শ্রমিক-কর্মচারীদের সংসার চলবে না। খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার পূরণ করা সম্ভব হবে না। সংসারের অশান্তি সব সদস্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। বাঁধবে ঝগড়া-বিবাদ। গার্মেন্ট শিল্পের এই পরিস্থিতি আরকত দিন চলবে তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই। গণমাধ্যমের খবর অনুসারে গার্মেন্ট শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বিলাসী জীবনযাপন করেন। তারা কোনো কারখানায় কাজ করেন না। অথচ শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাদের সংসার পরিচালনার চিন্তা নেই। তবে দরিদ্র গামেন্ট শ্রমিকদের কাজ না থাকলে ঘরে রান্না হবে না এটাই স্বাভাবিক। নেতারা হাতেগোনা কয়েকজন। শ্রমিকের সংখ্যা লাখ লাখ। তাই শ্রমিকের কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রশাসন ও মালিকপক্ষকে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।