ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্মার্ট শিক্ষার জন্য স্মার্ট শিক্ষক দরকার

ড. মো. মাহমুদুল হাছান
স্মার্ট শিক্ষার জন্য স্মার্ট শিক্ষক দরকার

স্মার্ট শিক্ষা হলো, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক শিক্ষা প্রদান করা, যাতে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের জন্য তাদের সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত করা যায়- যেখানে অভিযোজন যোগ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্মার্ট শিক্ষা শিক্ষার্থীদের প্রথাগত শিক্ষার বাইরে গ্লোবাল শিক্ষায় প্রবেশের উপায় অবলম্বন করতে শেখায়। এটা শুধু শিক্ষা প্রদানের পরিবর্তনই নয়, বরং প্রযুক্তির আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে আজকের শিক্ষকদের এখন থেকে ২০ বছর পরের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তার প্রক্রিয়া জানতে সাহায্য করে। স্মার্ট শিক্ষা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়কেই আগামীর জন্য নিজেদের কীভাবে প্রস্তুত করা যায়, সে সমস্যা সমাধান করতে পারে। স্মার্ট শিক্ষা একটি ভার্চুয়াল বা প্রথাগত উভয় পরিবেশেই শিক্ষণ-শিখন কার্যসম্পন্ন করতে শেখায়। এটি ভার্চুয়াল ও ফিজিক্যাল উভয়ের একটি মিশ্র সংস্করণও হতে পারে। ট্র্যাডিশনাল বা প্রথাগত শিখনফল নিশ্চিত করতে স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার হিসাবেও স্মার্ট শিক্ষাকে সংক্ষিপ্ত করা যেতে পারে। অনলাইন ভার্চুয়াল ক্লাসরুম, ভার্চুয়াল লার্নিং এনভায়রনমেন্ট, ক্লাউড সার্ভার, কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন ইত্যাদির মতো উন্নত শেখার পদ্ধতি ব্যবহার করে একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের আরো বেশি কার্যকর শিক্ষা প্রদান করতে পারে। এটি তাদের একটি ডিজিটাল ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা বৃদ্ধি করে, যাতে জীবনযাপন এবং কাজ করার নতুন প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হতে পারে। এ শিক্ষায় শিক্ষকদেরও আধুনিক দক্ষতা যেমন বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়ন পদ্ধতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয় এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের ঐতিহ্যগত শ্রেণিকক্ষে কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে, তা শিখতে হয়। বিশ্বের অনেক দেশই এখন স্মার্ট সিটির দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও হাতে নেয়া হয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর এই সিটির প্রকল্প। এই স্মার্ট সিটির প্রথম ও প্রধান শর্ত হচ্ছে, সেখানকার বাসিন্দাদের আবশ্যিকভাবেই স্মার্ট হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আর সেজন্য প্রথমেই গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষায়। শিক্ষা যদি স্মার্টপদ্ধতিতে না দেয়া যায়, তাহলে স্মার্ট জাতি গঠন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে আসতে হবে স্মার্ট প্রযুক্তির আওতায়। প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল শিক্ষা ছাড়া স্মার্ট জাতি গঠন করা যায় না। কারণ, ডিজিটাল শিক্ষার বাইরে থাকা মানুষ কোনো না কোনো সময় স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে বা সেটি ব্যবহারে তারা কখনও দক্ষ হয়ে উঠবে না। তাই শিক্ষকদের স্মার্ট টিচিং সিস্টেম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। স্মার্ট টিচিং সিস্টেম হলো একটি শেখার প্ল্যাটফর্ম, যা শক্তিশালী মডেল, কৌশল এবং আধুনিক সরঞ্জামগুলির সুবিধাগুলোকে একত্রিত করে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তাদের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে সহায়তা করে। এটি শিক্ষাদানের কার্যকারিতা এবং দক্ষতা তৈরির জন্য একটি দুর্দান্ত কৌশল। স্মার্ট সেরা শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের কোথায় দেখতে চায়, তা দেখিয়ে দেয়, কিন্তু শিক্ষার্থীরা কী দেখবে, তা বলে না। তারা হলেন একটি কম্পাস, যা কৌতূহল, জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার চুম্বককে সক্রিয় করে। স্মার্ট শিক্ষণ পদ্ধতি শিক্ষকদের বৃহত্তর কার্যকারিতা বিকাশে সহায়তা করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, কার্যকর শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। স্মার্ট শিক্ষক থেকে শিক্ষকদের কয়েকটি শিক্ষণ কৌশল অবলম্বন করতে হয়, যেমন-

১। টিচিং ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা : শিক্ষকদের পাঠনকর্ম শুরুর আগেই একটি টিচিং ফ্রেমওয়ার্ক আবিষ্কার করতে হবে, যা যেকোনো প্রথাগত পদ্ধতির চেয়ে দ্রুত শিক্ষাদানের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব অর্জনকে অভূতপূর্ব স্তরে উন্নীত করতে পারে।

২। শেখার দ্রুততম কৌশল বের করা : স্মার্ট শিক্ষক হতে তাদের শিখন- শেখানোর এমন কৌশল বের করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা গড় শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে দ্রুততম উপায়ে শিখতে পারে। যদি একটি পাঠ সম্পন্ন করতে সাধারণ শিক্ষকদের এক বছর সময় লাগে, তা শেষ করতে স্মার্ট শিক্ষকদের ৬ মাস কম লাগতে পারে। স্মার্ট শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে একই পাঠের জন্য ব্যাপক সময় ব্যয় করতে হয় না।

৩। গবেষণালব্ধ শিক্ষণ কৌশল গ্রহণ করা : কোনো শিক্ষার কৌশল সবচেয়ে ভালো কাজ করে, স্মার্ট শিক্ষককে সে বিষয়ে গবেষণা করতে হবে। সেরা শিক্ষণ কৌশল হলো বর্তমানের শিক্ষা প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে আগামী প্রজন্মের জন্য কোনো কৌশলটি যুগোপযোগী এবং দক্ষতানির্ভর তা গবেষণা করে বের করা এবং পাঠ-উপযোগী করে সেগুলো শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করা। এটি গবেষণালব্ধ বা প্রমাণভিত্তিক কৌশল নামেও পরিচিত। এ ধরনের কৌশলগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত এবং ছাত্রছাত্রীদের সফল ফলাফলের সঙ্গে সম্পর্কিত।

৪। নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা : চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শিক্ষায় নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে এবং পরবর্তীতে উন্নয়নের বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে আরো অনেক প্রযুক্তি নিয়ে আসবে। শিক্ষকদের এ সব প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তিগতভাবে যোগ্য ও দক্ষ করে তুলতে হবে। যুগের প্রেক্ষাপটে স্কুলগুলোতে আধুনিক সরঞ্জামাদি স্থাপন করে সেগুলোকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করতে হবে। শেখার পরিবেশগুলো ওয়েবভিত্তিক পরিবেশ দ্বারা তৈরি করতে হবে। স্মার্ট স্কুল ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষায় হতে হবে সর্বব্যাপী। স্মার্ট শিক্ষাধারা অব্যাহত রাখার জন্য পদ্ধতিগত পরিবর্তন এনে শিক্ষকদের নিত্যনতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। স্মার্ট শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতায় উন্নত হতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে।

৫। শিক্ষার্থীদের শেখার উপর ফোকাস করা : স্মার্ট শিক্ষকদের তাদের শিক্ষার্থীদের শিখন, তাদের আচরণবিধি এবং শ্রেণিকক্ষের শিক্ষণ কৌশলের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের ভালো ফলাফল অর্জন নিশ্চিত করতে স্মার্ট শিক্ষকদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বেশি বেশি স্মার্ট টিচিং সিস্টেম ব্যবহার করে শিক্ষকদের তাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে শেখার মানসিকতা তৈরি করতে হবে, যাতে প্রয়োজনীয় শিক্ষোপকরণ সংগ্রহসহ তারা সময় বাঁচাতে পারে।

৬। শেখার মৌলিক উপাদান একীভূত করা : স্মার্ট শিক্ষক সবসময় একটি শিক্ষামূলক মডেল তৈরি করতে পছন্দ করে। সেজন্য, তারা স্মার্ট স্কুল সিস্টেমের উপর জোর দিয়ে থাকে, যার প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি হলো শিক্ষার মৌলিক উপাদানগুলোকে একীভূত করা। তাদের শেখার বিষয়বস্তু, শিখন-শিক্ষণ কৌশল এবং বিতরণ পদ্ধতির ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। স্মার্ট টিচিং পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক বিকাশ, তথা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, মানসিক এবং শারীরিক দক্ষতা বিকাশের সুযোগ প্রদান করতে হবে। স্মার্ট পদ্ধতিতে শেখার সব উপাদান একত্রিত করে শিখনকর্মে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে এবং সহযোগিতার সংস্কৃতি চর্চা করে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে স্মার্ট ভূমিকা পালন করতে হবে।

৭। প্রয়োজনীয় অ্যাপ্স ও সফটওয়্যার সম্পর্কে জানা : স্মার্ট শিক্ষণ মূলত সফটওয়্যার সরঞ্জামগুলোর সাহায্যে শিক্ষাদান এবং শিক্ষক শেখার ক্রিয়াকলাপগুলো সংগঠন করে। তারা শিখন ও শিক্ষণকর্মে আবিষ্কৃত প্রয়োজনীয় সকল অ্যাপ্স ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্মার্ট শিক্ষায় শিক্ষিত করে। ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), চ্যাটজিপিটি, গুগল ক্লাসরুম, জুম প্লাটফর্মসহ ডিজিটাল ক্লাসরুমের কাজে ব্যবহৃত সব ডিভাইস ও অ্যাপ্সসহ শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করতে স্মার্ট শিক্ষকরা সচেষ্ট থাকে।

৮। ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি করতে জানা : স্মার্ট শিক্ষকদের ডিজিটাল পদ্ধতি অবলম্বনের সঠিক কৌশল জানতে হবে এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের উপযুক্ত নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জানতে হবে। ব্যবহারে ও বাস্তবায়নে প্রশিক্ষিত হতে হবে। উন্নত এলএমএস গ্রহণ, পাঠ পরিকল্পনা তৈরি এবং বিভিন্ন ই-কন্টেন্ট সম্পর্কে শিক্ষকদের সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। ওয়ার্কশপ, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ নানাবিধ প্রশক্ষণ কর্মশালা শিক্ষকদের শেখার এবং শেখানোর কৌশল উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। তবে শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি যেটি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, স্মার্ট টিচিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ নিশ্চিত করা। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্মার্ট করা। অর্থাৎ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি শিখন ও শিক্ষণ কাজে ফলাফলভিত্তিক অনলাইন টুলস, ডিজিটাল সরঞ্জামাদি, আধুনিক প্রযুক্তি সম্মৃদ্ধ স্পেস নিশ্চিত করা যায়, তাহলে শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের অনায়াসে স্মার্ট করে গড়ে তুলতে পারে।

বর্তমানে শিক্ষার্থীরা ঐতিহ্যগত বক্তৃতা পদ্ধতির চেয়ে ইন্টারেক্টিভ শেখার অভিজ্ঞতা পছন্দ করতে শুরু করেছে। আর এটি কার্যকর করতে স্মার্ট পদ্ধতির শিক্ষাই এখন শিক্ষার্থীদের ভীষণ পছন্দ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বিদ্যমান শ্রেণিকক্ষকেন্দ্রিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে, স্মার্ট শিক্ষকরা তাদের ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিখনফলভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে।

অনলাইনে উপলব্ধ অনেক তথ্যসহ একজন স্মার্ট শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নোট দিতে এবং রিয়েল-টাইম শিক্ষা দিতে সক্ষম হয়। তারা শ্রেণি-কার্যক্রমভিত্তিক শিক্ষাকে আরো আকর্ষণীয় এবং আনন্দদায়ক করে তুলতে পারে।

লেখক : এডুকেটর, প্রিন্সিপাল এবং প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক (বিডিসেন)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত