ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নিজে না বদলালে কিছুই বদলানো যায় না

এস এম মুকুল
নিজে না বদলালে কিছুই বদলানো যায় না

আমাদের জনগণের কোনো সুস্থির চিন্তা নেই। তাই দল আর মার্কার বাইরে ব্যক্তি ইমেজ বা যোগ্যতার ভোটব্যাংক তৈরি হচ্ছে না। আর যতদিন না এই পরিবর্তন আসবে, ততদিন রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আশা করা যায় না। আমার কাছে যা মনে হয়- রাজনীতিবিদরা নিজেরা বদলাবেন না, জনগণকেই তাদের বদলে যাওয়ার স্রোতে আসতে বাধ্য করতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন দল বা মার্কা নয়, ব্যক্তি ইমেজের প্রতি সমর্থন জোড়ালো করা। আমরা যদি বেছে বেছে ব্যক্তি ইমেজ দেখে যোগ্যতম লোককে ভোট দিই তাহলে- ভালো ভালো কিছু যোগ্য, সাহসী, মানুষ নির্বাচিত হয়ে আসবেন। এভাবে একটি নির্বাচনে ১০০ জন সংসদ সদস্য পজিটিভ পার্সন জয়ী হয়ে এলে অন্যদের মধ্যে এমনকি নেতৃত্বে মধ্যেও পরিবর্তন আনতে বাধ্য হবেন। এভাবে যদি জনগণ বিশেষ করে তরুণ সমাজ দুই জোটের ভোট ব্যাংক ভেঙে দিয়ে ব্যক্তি ইমেজকে গুরুত্ব দেয়, তাহলে পাল্টে যেতে পারে রাজনীতির ভোল। দেশে যেহেতু তৃতীয় শক্তি নেই, সেহেতু কোনো জোট বা কোনো দলকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যক্তি ইমেজের প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়ালে রাজনীতিতে নতুন নতুন মুখ আসবে। এই নির্বাচনে যদি ব্যক্তি ইমেজের কারণে ১০০ জন নির্বাচিত হয়, তাহলেই পাল্টে যাবে পরবর্তী সময়ের রাজনীতির রূপরেখা। এই অবস্থাটা সব দলের লোকেরাই আন্দাজ করতে পারছেন। অনেক নেতা, সংসদ সদস্য এমনকি মন্ত্রী পর্যন্ত মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনের কথা বলছেন প্রকাশ্যে। কাজেই ক্ষমতা যে জনগণের হাতে সেটা বুঝিয়ে দেয়া দরকার। জনগণের অসন্তোষ গুরুত্ব না দিয়ে একদল হরতাল ডাকবে, আর অপর দল জনগণের অসন্তোষ বা আন্দোলনকে আমলে না নিয়ে বিতর্কিত মন্ত্রীকে প্রত্যাহার করবে না- এমনটি আর চলতে দেয় যায় না। এই মানসিকতার পরিবর্তন চাই। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন চাই।

টক-শো থেকে গোলটেবিল, কলাম থেকে সংবাদ আর রাজনীতিবিদের গলাবাজির মোক্ষম হাতিয়ার- চলমান আদল বদলাতে হবে। একটি জাতীয় পত্রিকার স্লোগান ছিল- বদলে যাও বদলে দাও। সম্প্রতি রাজনৈতিক আদর্শ বদলের মাধ্যমে নতুন ধারার সরকার গঠনের ঘোষণা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। মনে প্রশ্ন জাগে, এই বদলে দেয়ার জোয়ারে আম জনতায় গা-ভাসিয়ে ভোট ব্যাংক ভরে দিবেন কি? আমাদের ভোটে ক্ষমতায় গিয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শের বদল বা পরিবর্তন আদ্যে কি হয়? প্রশ্ন থাকে- এসবের ফলে আদৌ কি বদলায় আমাদের রাজনৈতিক কৃষ্টি-কালচার, দৃষ্টিভঙ্গি? বদলের প্রভাব কতখানি পরে আমাদের জীবনমানে? এই দুটি দলের রাজনীতিবিদরা শুধু দল ও ব্যক্তিস্বার্থে কি পরিমাণ মিথ্যাচারে পরস্পরবিরোধী হতে পারেন তার নমুনা প্রতিনিয়ত দেখছে দেশের জনগণ। আমরা কখনো এক হয়ে বলতে পারিনি, আমাদের দেশ আমরাই গড়ব। সরকারের ব্যর্থতা থাকলেও বিরোধী দল দেশবান্ধব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় না। আবার বিরোধীরা কখনো এগিয়ে আসতে চাইলেও সরকার আশ্রয় দেয় না। এমন নোংরা মানসিকতা নিয়ে রাজনীতি করেন তারা! প্রাকৃতিক বিপর্যয় অথবা দুর্ঘটনা ঘটলে বিরোধী দল সোচ্চার হয়। সরকারের ত্রুটি বলে বেড়ায়। ত্রাণ যাচ্ছে না, উদ্ধারকার্য সঠিক হচ্ছে না, এই ঘটনার জন্য কোনো না কোনো রাজনৈতিক রং লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আমরা দেখতে পাই না যে, একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা দুর্ঘটনায় সরকারের পাশাপাশি সবার আগে পরিস্থিতির উত্তরণে বিরোধী দলও কাজ করছে। সরকারের দায় ও দায়িত্ব বেশি হলেও বিরোধী দলগুলোর দায়িত্ব কম নয়। কারণ তারাও জনপ্রতিনিধি। কিন্তু তারা কি তা পরিপালন করেন? সরকারের সাহায্য সহযোগিতার অপ্রতুলতা বা ত্রুটি নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি তারা নিজেদের অঢেল বিলাসী জীবন থেকে কতটুকু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন? যারা নিজেরা বদলায় না- তারা বদলের নামে জনগণকে ধোকা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই বদল বা পরিবর্তনের বুলি আওড়ান মাত্র। দুঃখজনক, খুবই দুঃখজনক।

এসব দেখতে দেখতে আমরাও অতিষ্ঠ এবং অভ্যস্ত। আমাদের তো দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমরা আর পারি না। দ্রব্যমূল্যের যাতাকলে আমরা পিষ্ট। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনমান এখন খুবই কষ্টকর। তাই রাজনীতিবিদের মন ভোলানো কথা এখন আর জনগণ বিশ্বাস করে না। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো- চলমান রাজনীতির প্রতি জনগণ আস্থা হারালেও বিকল্প কোনো উত্তম নেই আমাদের সামনে। হয় আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি-এর বাইরে যাওয়ার অপশন নেই। একারণে আমাদেরও অভ্যাসে পরিণত হয়ে হয়েছে একবার আওয়ামী লীগকে ভোট ব্যাংক দিয়ে প্রত্যাশা পূরণ না হলে পরেরবার সবাই গামছা বেঁধে নামব বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে। রাজনৈতিক মানসিকতার কারণে এক সরকার গত হলে তাদের সময়ের চলমান প্রকল্পগুলোর অনেক কিছুই বন্ধ হয়ে যায় অথবা চলে ঢিমেতালে। তাই আমাদের দেশেও জনগণকেই সচেতন হতে হবে সবার আগে। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব নিজেদের বদলাবে না, যতক্ষণ না জনগণ তাদের বাধ্য করেছে। তাই রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে জনগণকেই। আর এর নেতৃত্ব দিতে পারে আমাদের তরুণ সমাজের ভোট ব্যাংক।

বলা হয়ে থাকে, তরুণরাই পরিবর্তনের মোক্ষম হাতিয়ার। ধারণা করা হচ্ছে- এবার তরুণ, নবীন ও নারী ভোটারদের ভোটেই আগামীর বাংলাদেশের পরিবর্তনের শুভসূচনা হতে পারে। তাই বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে- এজন্য প্রয়োজন তরুণ, নারী ভোটার বিশেষ করে নবীন ভোটার যাত্রা জীবনের প্রথমবার ভোট দিবেন, তাদের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার সঙ্গে যেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ দেয়া হয়। পাশাপাশি পরিবর্তনের সারথী এই ভোটাররা যেন যোগ্যপ্রার্থীকে তাদের ব্যালট দিয়ে আগামীর উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রাকে বেগবান করতে সহায়তা করে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪০ লাখের বেশি। ১৮ থেকে ২৮ বছরের তরুণ ভোটারের সংখ্যা সোয়া ২ কোটি। তবে এরই মধ্যে পুরুষ ভোটার বেশি। ২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর থেকে ১০ বছরে দেশে ভোটার বেড়েছে সোয়া ২ কোটির বেশি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের কাছে টানতে বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। নানা সুযোগ-সুবিধা ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নির্বাচনি ইশতেহার। একাদশ নির্বাচনে ভোটার ১০ কোটি ৪১ লাখেরও বেশি ভোটারের মধ্যে ১৮ থেকে ২৮ বছর বয়সি তরুণ ভোটারের সংখ্যা সোয়া ২ কোটি। এ কারণে নির্বাচন বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, নির্বাচনে এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ ভোটারই নিয়ামকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। বলা হয়ে থাকে, একটি দেশের যুবশক্তি বা তরুণের সংখ্যা যত বেশি, সে দেশের ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও তত বেশি। তবে যথাযথভাবে তরুণ সম্প্রদায়ের মেধা-মননকে কাজে লাগাতে না পারলে সমূহ বিপদের আশঙ্কাও অমূলক নয়। এদিক থেকে বিবেচনা করলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে তরুণদের ভোটের উপর যেমন নির্ভর করছে ইতিবাচক রাজনীতির লক্ষ্য অর্জন, তেমনি আবার রাজনৈতিক দলগুলোর তরুণদের কর্মসংস্থান ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণবান্ধব ইশতেহারের উপর নির্ভর করছে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন সোপান। ইতিশেহার প্রসঙ্গে আসলেই যে বিষয়টি গুরুত্ব পায়, তা হলো ইশতেহারের বিষয় নির্বাচন কেমন হবে। বর্তমান আধুনিক জমানার তরুণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্পষ্ট, লক্ষ্যনির্ভর। একালের তরুণরা রাজনৈতিক নোংরামি পছন্দ করে না। তরুণ সমাজ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা চায়, উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। তাই বর্তমান সময়ের জনপ্রত্যাশা হলো- তরুণ সমাজের মেধা, শ্রম ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা এবং কাজে লাগানো। দেশজুড়ে আলোচিত হচ্ছে এইসব ভাবনা। কারুণ তরুণ সমাজকে অমর একুশ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত করতে পারলে দেশ সঠিক পথে এগিয়ে যাবে। তাই সচেতন অভিভাবক মহলের প্রত্যাশা- নির্বাচনি ইশতেহারে তরুণ সমাজকে দেশ গঠনে এবং উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে যাদের কর্মসূচি গ্রহণযোগ্য মনে হবে, তাদেরই ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবে তরুণ সমাজ। চলতি দশকে বাংলাদেশে তরুণদের সংখ্যাধিক্যকে দেশের সামগ্রিক সম্ভাবনায় প্রধানতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করছে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্লেষণ। নবম সংসদ নির্বাচনের পর যারা ভোটার হয়েছেন, তাদের আমরা তরুণ ভোটার হিসাবেই বিবেচনা করতে পারি। বলতে দ্বিধা নেই আমাদের এই তরুণরাই উদ্ভাবনী ক্ষমতা, প্রায়োগিক শিক্ষা, উন্নত জীবনযাপন ও প্রগতিশীল চিন্তাচর্চায় দেশ মাতৃকার প্রতি ভালোবাসার সাক্ষর রাখবে। এসব কারণেই একাদশ সংসদ নির্বাচনে তরুণ, নবীন ও নারী ভোটাররাই হবেন ক্ষমতার পালা বদলের বড় নিয়ামক। আমাদের প্রিয় নবীজির মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দেয়ার সেই ঘটনাটি এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। গরিবের ছেলে মিষ্টি খেতে পছন্দ করে। সামর্থ্যরে অভাবে ছেলের চাহিদা পূরণে অক্ষম বাবা। কি করা যায়? ছেলেকে নিয়ে প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর কাছে এসে ছেলেকে বুঝিয়ে বলতে অনুরোধ জানালেন। নবীজি পড়লেন বিপদে। তিনি নিজেই যে মিষ্টি প্রিয় মানুষ। তাই সেদিন ছেলেকে কিছু না বলে সাত দিন পর আসতে বললেন। ব্যস, এ কয়দিনে নিজের প্রিয় খাবারের অভ্যাসটুকু নিজেও ত্যাগ করলেন। যথারীতি পরামর্শ প্রার্থী ছেলেকে নিয়ে আসলে তিনি বাস্তবতার বুঝ দিয়ে ছেলেকে মিষ্টি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিলেন। এ গল্পটি নিশ্চয়ই সবারই জানা আছে। তবুও উল্লেখ করলাম কারণ, অভ্যাস বদলের উপদেশ প্রদানে এর চেয়ে সুন্দর, শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত বোধ করি আর নেই। কাজেই ‘নিজে না বদলালে কিছুই বদলানো যায় না’ কথাটির প্রকৃত অর্থ- ‘আগে নিজের মজ্জাগত স্বভাব বা অভ্যাস বদল- পরে অন্যকে বদলাতে বলো’। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটছে তার পুরো উল্টোচিত্র। চলমান সময়ে পরিবর্তন বা বদলে যাওয়া নিয়ে যে ঢাকঢোল পিটানো হয়, তাতে এর প্রকৃত উদ্দেশ্যই যেন বিলীন হয়ে যায়। কেন বদলে যেতে বলছি, কাদের বদলে যেতে বলছি, নিজেরা কতোটা বদলাতে পেরেছি? কীভাবে বদলাতে হবে? এসব প্রশ্ন এ ধরনের উদ্যোগকে বিদ্ধ করে। তবুও বাস্তবতা হলো আমাদের বদলাতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কৃষি-অর্থনীতি বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত