ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অভিমত

নজরুলের গানের সুর বিকৃতি এ আর রেহমানকাণ্ড

রফিক সুলায়মান
নজরুলের গানের সুর বিকৃতি এ আর রেহমানকাণ্ড

এ আর রেহমান একজন লিজেন্ড সঙ্গীতজ্ঞ। সর্বভারতে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন ২১-২২ বছর বয়সে ‘রোজা’ সিনেমার সৌজন্যে, গত শতাব্দীর নব্বই দশকের শুরুতেই। ছিলেন হিন্দু, পরে সপরিবারে ধর্মান্তরিত হয়ে সুরা ‘আর রহমান’র অনুকরণে নিজের নামকরণ করেন। ‘রোজা’, ‘বম্বে’, ‘দিল সে’, ‘পরদেশ’, ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’, ‘রকস্টার’, ইত্যাদি চলচ্চিত্র তাকে সুসংহত আসন, অর্থ-বিত্ত, অস্কার এনে দিয়েছে। এ আর রেহমান এবার কবি নজরুলের গানের বারোটা বাজিয়েছেন। ভারতবর্ষের জাগরণের গানের অন্যতম মাইলফলক ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ কে ব্যবচ্ছেদ করেছেন নিজের স্টাইলে। জাগরণের গানকে ঘুমপাড়ানি স্টাইলে উপস্থাপন করেছেন পিপ্পা চলচ্চিত্রে। মূল সুরের ধারে কাছেও নেই। একটি ঐতিহাসিক গানের অপমৃত্যু ঘটালেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো এই গানের প্রসঙ্গ না এলে রাজাকৃষ্ণ মেনন পরিচালিত লো বাজেটের সিনেমা পিপ্পার কথা কেউ মনেও রাখত না। মুক্তি পেত আর হারিয়ে যেত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বানানো এই সিনেমার কাহিনীর কথা বাংলাদেশের কেউ শুনেছে বলেও মনে হয় না। তাই ভাবনা অমূলক নয় যে সিনেমাটিকে আলোচনায় আনার জন্যই এই অভাবনীয় বিতর্ক চাউর করা। তবে দুঃখ লাগে নজরুলের প্রতি বলিউডের এই অবহেলা দেখে। প্রকারান্তরে অবহেলা করা হলো দেশবন্ধুকেও। কারণ, চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রীর অনুরোধে কবি গানটি লিখেছিলেন। দেশবন্ধুর সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক সমন্ধে সবাই কম-বেশি অবগত। অন্তত যারা সাহিত্যের খোঁজখবর রাখেন। তার অকালপ্রয়াণে ব্যথিত কবি গোটা একটি কাব্যগ্রন্থ ‘চিত্তনামা’ প্রণয়ন করেছিলেন। ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ সম্পর্কে আমরা জানি যে ইংরেজ শাসনের বিরোধিতার কারণে দেশবন্ধুসহ যারা জেলে ছিলেন- কারাগারে তাদের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে এই গান। ১৯৪৯ সালে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ সিনেমায় এটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। এরপর ৬৯-৭০ সালে জহির রায়হান তার কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় এই গান ব্যবহার করেন। সবচেয়ে বড় কথা এই গান আর নজরুল প্রায় সমার্থক। বিদ্রোহী কবিতার মতো ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ আমাদের প্রাণের কবির একটি প্রতিনিধিত্বশীল সৃষ্টি। অথচ এ আর রেহমান গানটিকে কবর দিয়েছেন সুরবিকৃতির আশ্রয় নিয়ে। আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে রাখলাম। কিছুদিন আগে শিল্পী অভিজিতের একটি সাক্ষাৎকার দেখছিলাম ইউটিউবে। তিনি মনে করেন, এ আর রেহমান বাদ্যযন্ত্রীদের পেটে লাথি মেরেছেন। এক কি-বোর্ড দিয়েই তিনি বিবিধ সাউন্ড সৃষ্টি করেন। তার সৃষ্ট সুর অনেকগুলো সাউন্ডের মিলিত প্রকাশ মাত্র। ভারতের মূলধারার গান, সুর, দ্যোতনা নয়। ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গান নিয়ে বিতর্ক শুরু না হলে ‘পিপ্পা’ সিনেমাটি নিয়ে বাংলাদেশে ইতিবাচক আলোচনা শুরু হতে পারতো। মুক্তিযুদ্ধে আলোচিত ‘গরিবপুর যুদ্ধ’ নিয়ে সিনেমাটি। যশোরের কপোতাক্ষের তীরে সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মঞ্জুরের অধিনায়কত্বে অনন্য এই যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। এতে ভারতীয় বাহিনীর ক্যাপ্টেন বিএস মেহতা উপ-অধিনায়ক ছিলেন। যুদ্ধটি হয়েছিলো ১৯৭১ এর নভেম্বরে। এর কিছুদিন পর ভারত ডিসেম্বরের ৩ তারিখে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে।

বিএস মেহতা অর্থাৎ বলরাম সিং মেহতা পরবর্তী সময়ে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে অবসর নেন। তার লেখা গরিবপুর যুদ্ধ নিয়ে অসাধারণ একটি বই ‘দ্য বার্নিং শাফিজ’। শাফি আমেরিকার তৈরি ট্যাংক। গরিবপুর যুদ্ধ নিয়াজীর অহংকার মাটিতে মিশিয়ে দেয়। পাকিস্তানের ট্যাংকগুলো ছাইভস্মে পরিণত হয়। উপ-অধিনায়ক হিসেবে তিনি বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আর অধিনায়ক জেনারেল মঞ্জুর (সেই সময় লে. কর্নেল) প্রশংসিত হন।

ভারত তার পূর্বাঞ্চল কমান্ডের এই অনন্য অবদানকে সেলুলয়েডে বন্দি করেছে। দ্য বার্নিং শাফিজ অনুসারে স্ক্রিপ্ট লিখিত হয়েছে। ছবি প্রযোজনা করেছেন অভিনেত্রী বিদ্যা বালানের স্বামী সিদ্ধার্থ রায় কাপুর এবং রনি স্ক্রুওয়ালা। একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন মহেশ ভাটের পত্নী সোনি রাজদান।

পিপ্পা সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি বিকৃত সুরে। এখন আমাদের কী করা উচিত? কবি পরিবার, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, চুরুলিয়ার নজরুল একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ, ময়মনসিংহ নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, আসানসোল নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, প্রনস- প্রত্যেক সংগঠন ও এর সকল সদস্যের উচিত এই ঘটনার প্রতিবাদ জানানো। পিপ্পা চলচ্চিত্র থেকে গানটি প্রত্যাহার করে মূল সুরে এর ব্যবহার সুনিশ্চিত করা হোক। এরই মধ্যে দুই বাংলার সংস্কৃতিসেবীরা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন যার যার জায়গা থেকে। প্রতিবাদ অব্যাহত থাকুক।

পরিচিতি : লেখক ও শিল্প-সমালোচক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত