ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কুষ্ঠজনিত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রোধে এগিয়ে আসুন

মো. সাজেদুল ইসলাম
কুষ্ঠজনিত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রোধে এগিয়ে আসুন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানসিক স্বাস্থ্য হচ্ছে সবার জন্য মৌলিক মানবাধিকার। সবার মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে পরিত্রাণ পাবার, মানসম্মত স্বাস্থ্য পরিচর্যা পাওয়ার, স্বাধীনতা ও সমাজে অন্তর্ভুক্তির অধিকার রয়েছে। কল্যাণ ও সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো মানসিক স্বাস্থ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বব্যাপী প্রতি আটজনের একজন মানসিক সমস্যাজনিত সমস্যায় ভুগছে, এটা তাদের দৈহিক স্বাস্থ্য, কল্যাণ, সামাজিকতা ও জীবিকার বিষয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হতাশা, বিষন্নতা, অপ্রাপ্তি, একাকিত্ত মানুষের মনোজগতে এ সবের প্রচণ্ড প্রভাব। মানসিক রোগের কারণ ও চিকিৎসাবিষয়ক কুসংস্কার দূর করা ও দুশ্চিন্তামুক্ত প্রাণোচ্ছ্বল জীবনযাপনেই এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাবে। শরীর ও মন, এই দুই নিয়েই হচ্ছে মানুষ। সুস্থ-সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে গেলে সুস্থ শরীর ও সুস্থ মন সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কুষ্ঠরোগ বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় স্বাস্থ্য সমস্যা। এর কারণে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও অন্যান্য সমস্যারও সূত্রপাত হয়েছে। কুষ্ঠ প্রায় ৪০০০ বছরের পুরোনো। এটাকে ঘিরে সমাজে নানা কুসংস্কার প্রচলিত আছে। যেমন বলা হয়, এটা সৃষ্টিকর্তার তরফ হতে পাপের কারণে শাস্তি, এটার কোনো চিকিৎসা নেই, শুধুমাত্র বয়ষ্ক ব্যক্তিরা এই রোগে আক্রান্ত হয়, রোগীদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা করে রাখা হয়, এটা ব্যাপকভাবে ছোঁয়াচে প্রকৃতির রোগ, এই রোগের কারণে অঙ্গহানি হয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে যায় ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কুষ্ঠ কোনো অভিশাপ, বংশগত বা ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটি অন্যান্য রোগের মতোই একটি সাধারণ জীবাণুঘটিত রোগ। এটি নিয়মিত ও সময়মতো চিকিৎসায় ভালো হয়। কুষ্ঠ সম্পর্কে জানা ও উচ্ছেদ কার্যক্রমে রোগীদের পুনর্বাসন কার্যক্রমে অংশ নেওয়া দরকার। কুষ্ঠকে ঘিরে কুসংস্কার থাকায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা হয়। এর ফলে রোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মানসিক কল্যাণ বাধাগ্রস্ত হয়। এই রোগের উপসর্গ আক্রান্ত ব্যক্তিদের লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রোগীদের মধ্যে মানসিক অচলাবস্থা, উদ্বেগ ও আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

মানসিক দুশ্চিন্তা, নিজেদের সম্পর্কে আত্মসম্মান বোধের অভাব, শঙ্কা, দুঃখবোধ, রাগ ও জীবনের নিম্নমানের বিষয়টিও কুষ্ঠের কারণে তৈরি হয়। কুষ্ঠরোগের বিষয়ে ভুল ধারণার কারণে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যুগ যুগ ধরে সমাজ, এমনকি একান্ত আপনজনের কাছেও অবহেলিত ও লাঞ্ছিত। আমাদের দেশে তাই কারো কুষ্ঠ হলে তাকে অনেক দুঃখ, কষ্ট, লাঞ্চনা ও বঞ্চনার আঘাত সহ্য করে জীবনকে বড় এক বোঝার মতো মেনে নিয়ে চলতে হয়। এসব মানুষের জীবনকে সমাজ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী বিধ্বস্ত করে দেয়। কুষ্ঠজনিত পঙ্গুত্ব ও কুসংস্কারের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা মানসিক সমস্যায় পতিত হন।

কুষ্ঠকে ঘিরে আমাদের সমাজে কুসংস্কার রয়েছে যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখী হন, এটা তাদের মানসিক সমস্যার কারণ। কুষ্ঠ চিকিৎসাযোগ্য একটি রোগ, নিয়মিত চিকিৎসায় এটি ভালো হয়, তা সত্ত্বেও যারা আক্রান্ত হন তাদের সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাস করতে বাধ্য করা হয় এই কুসংস্কারের কারণে। আক্রান্ত ব্যক্তিরা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বৈবাহিক সম্পর্ক, মানসম্মত শিক্ষা এবং জীবিকার জন্য কাজ পেতে সমস্যার সম্মুখীন হন। এই রোগের কারণে যারা সমাজচ্যুত ও একাকি থাকতে বাধ্য হন, যারা নিজের যত্ন ও কাজে সমস্যা বোধ করেন এবং দৃশ্যমান প্রতিবন্ধিতা রয়েছে, তাদের মাঝে ডিপ্রেশনের উপসর্গ লক্ষ্য করা যায়। কুষ্ঠজনিত কারণে কোনো ব্যক্তি পঙ্গু হলে আক্রান্ত ব্যক্তিরা দারিদ্র্য, কুসংস্কার, বৈষম্য, নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। আশপাশের লোকজনের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তখন তারা নিজেদের মূল্যহীন বা অযোগ্য মনে করে। এই বছরের (২০২৩) ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সফরকালে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতাকালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের স্পেশাল রেপোর্টিয়ার এলিস ক্রুজ এই দেশে কুষ্ঠ আক্রান্তদের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন ও তাদের স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চনার বিষয়গুলো তুলে ধরেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ সরকার এদেশে কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলে তিনি মনে করেন।

কুষ্ঠবিরোধী কার্যক্রমে সফল হতে হলে এই খাতে বাজেটে পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ থাকা জরুরি বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন। রোগটির বিষয়ে দুশ্চিন্তা বা লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ এটি সম্পূর্ণভাবে চিকিৎসাযোগ্য বা সময়মতো চিকিৎসায় ভালো হয়। কুষ্ঠজনিত মানসিক সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে এই রোগ সম্পর্কে লোকজনের মনোভাব পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে, কারণ মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য কুসংস্কার বড় রকমের ভূমিকা পালন করে। আমাদের উচিত এই সমস্ত দুর্দশাগ্রস্তদের প্রতি দয়া ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। এটা তাদের জীবনকে ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন করতে পারে। বিভিন্ন সমস্যার মাঝে আক্রান্ত ব্যক্তিরা আপনার সহযোগিতা পেলে তাদের সংকট উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

এই রোগ নির্মূল করতে হলে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে সচেতনাতামূলক প্রচারণা কার্যক্রম চালাতে হবে। কুষ্ঠ সংক্রান্ত যাবতীয় বৈষম্য ও কুসংস্কার দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার। সমাজের সদস্য হিসাবে আমাদের এই বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিত এবং দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কুষ্ঠরোগ কোনো অভিশাপ নয়; এই রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে পাওয়া যায়; রোগ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করা জরুরি; এই রোগের কারণে যে কোনো প্রকারের সামাজিক বৈষম্য বড় অপরাধ। কুষ্ঠ সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা ও তথ্য প্রদান, গণসচেতনতা সৃষ্টি করা, কুষ্ঠ রোগীদের শনাক্ত করা, যে কোনো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দান, রোগের শিকার ব্যক্তিদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ তাদের আর্থ-সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করা ইত্যাদি সমন্বয়ে সামগ্রিক সেবার কাজ করা দরকার। নিজ পরিবার পরিজন, সমাজ সরকার, কর্মক্ষেত্র, চিকিৎসালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানাদি থেকে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অতীতে এবং বর্তমানেও অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক মানবাধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। অধিকার বঞ্চিত এইসব মানুষের পক্ষে কথা বলে এবং তারা যেন নিজেরাই তাদের কথা বলতে পারে তার জন্য তাদের পাশে দাঁড়াতে সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলো চিকিৎসা থেকে শুরু করে রোগীদের আর্থ-সামাজিকভাবে নিজ পরিবার ও সমাজে পুনর্বাসিত করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে কাজ করতে পারে। আমাদের উচিত কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেন সমাজের অন্য মানুষের সঙ্গে সমান অধিকার ও মর্য়াদা নিয়ে বাস করতে পারে, তার জন্য কাজ করা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত