ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাইডেন-জিনপিং বৈঠক; বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে কতটুকু আশা জোগাবে?

অলোক আচার্য
বাইডেন-জিনপিং বৈঠক; বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে কতটুকু আশা জোগাবে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক যে উত্তপ্ত এবং দুই দেশের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ সে কথা নিঃসন্দেহ। বিভক্ত বলয়ে বিভক্ত বিশ্ব। বলা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুই দেশ দুই মেরুর বাসিন্দা। উভয় দেশ উভয় দেশের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সজাগ এবং প্রায়ই এ নিয়ে কথার সূচনা হয়। এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের বলয় শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা করছে উভয় দেশই। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের আগ্রাসন, বিশ্বজুড়ে ব্যাপক নিন্দার পরেও যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলকে সমর্থন করা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেনকে সমর্থন এবং চীনের কিছুটা নিষ্ক্রিয়তা, জলবায়ু ইস্যুতে দুই দেশের আগামী পদক্ষেপ এসব অমীমাংসিত এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য মতবিরোধ ইস্যুগুলো বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং শি জিনপিংয়ের মধ্যেকার বৈঠকে আসতে পারে। এর বাইরেও দুই দেশের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো আসতে পারে। বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের বিষয়টিও জোরেশোরে আলোচনায় থাকার কথা। সে কারণেই চীনের প্রেসিডেন্টের যুক্তরাষ্ট্রের সফর ঘিরে নজর সারা বিশ্বেরই। কারণ সামনেই মার্কিন মুলুকের নির্বাচন এবং জো বাইডেন দ্বিতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর দৌড়ে রয়েছেন। উভয় দেশের বড় কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা না থাকলেও উভয় দেশের চলমান উত্তেজনা যে একটু ঠান্ডা হবে, এটা আশা করা হচ্ছিল। সেটা হয়তো কিছুটা সফলও হয়েছে। অন্তত সফর এবং মতবিনিময় তো হয়েছে। এটা ছিল উভয় দেশের সম্পর্ক মেরামতের একটি বড় সুযোগ। উভয় দেশের সম্পর্ক যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে কাছে ভবিষ্যতে যদি দুই দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর জন্য তা হবে প্রলয়ংকর পরিস্থিতি। এই দুই দেশ গত কয়েক বছর ধরেই তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। অস্ত্র, ব্যবসায়-বাণিজ্য, কূটনীতিসহ প্রতিটি বিষয়েই এই দ্বন্দ্ব বিদ্যমান রয়েছে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে শক্তিধর দেশগুলো স্বাভাভিকভাবেই নানাভাবে উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থায় থাকে। এপেক সম্মেলন উপলক্ষ্যে জিনপিং আসছেন যুক্তরাষ্ট্রে। দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার সম্ভব না হলেও সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার একটি সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বে গত কয়েক বছর ধরে এই দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক টানাপড়েন চলছে।

যদিও বছরখানে আগে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জি-২০ জোটের সম্মেলনে দুই নেতার মধ্যে বৈঠক হয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের যে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল, সে প্রতিশ্রুতি খুব বেশিদূর অগ্রগতি হয়নি। গত কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্র চীনের শতাধিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। চায়না সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক চেঞ্চের প্রধান অর্থনীতিবিদ চেন ওয়েনলিংয়ের একটি গবেষণায় দেখানো হয়, ২০১৮ সালের পর চীনের ৭২৫টি প্রতিষ্ঠান ও ২৪১ জন ব্যক্তির ওপর অবরোধ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

এর বিপরীতে চীনও বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আগামী ১৫ নভেম্বর এই দুই ক্ষমতাশালী প্রেসিডেন্টের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো মুখোমুখি সাক্ষাৎ হচ্ছে। বিবিসি সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন ইসরাইল-গাজা যুদ্ধ, তাইওয়ান, ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং নির্বাচনে হস্তক্ষেপের মতো অনেক বিষয়ই উঠে আসবে এ বৈঠকে। এই বছরের শুরুতে দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরে। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে যে চীন তাদের আকাশে একটা স্পাই বেলুন পাঠিয়েছে। পরে মার্কিন যুদ্ধবিমান সেটি দক্ষিণ ক্যারোলিনার উপকূলে ভূপাতিত করে। এর আগে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সেই সময়ের হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করেন, যার জেরে দুই দেশের মধ্যে সামরিক যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় চীন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সেই উত্তেজনার পারদ এমনিতেই অনেক উপরে উঠে আছে। উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য, প্রযুক্তি, আধিপত্যবাদ বিস্তার, সামরিক শক্তি প্রভৃতি বিষয়ে প্রতিযোগিতা চলে আসছে। গত কয়েক বছরে এই সম্পর্ক আরো বেশি তিক্ত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে চলে আসছে শীতল যুদ্ধ। যদিও সরাসরি বিষয়টি বলা হয় না কিন্তু এটা সত্যি। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে চীন। মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে চীনের বর্তমান সফলতাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ এখন চীন। সুতরাং চীনকে উপেক্ষা করে পৃথিবীতে শান্তি প্রক্রিয়ার চেষ্টা অর্থহীন হবে। আর যদি উভয় পরাশক্তি দেশগুলো চায়, তাহলে পৃথিবীতে শান্তি ফেরানো সম্ভব। এখন উভয় দেশের সামনে বেশ কয়েকটি ইস্যু। বৈশ্বিক অর্থনীতি, বাজার, দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তার, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, তাইওয়ান ইস্যু এবং সর্বশেষ ফিলিস্তিন ইস্যু ইত্যাদি। দুই দেশের আলোচনায় কোনো সরাসরি চুক্তি হলে সেটি দৃশ্যমান কোনো অর্জন বলা যায়। কিন্তু যদি সেটি না হয়, তাহলে একটি সম্ভাবনা, একটি তিক্ততার অবসান ঘটার সম্ভাবনা থাকে। কারণ শেষ পর্যন্ত আলোচনাতেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। এমনকি এটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য।

দুই দেশের মধ্যে ‘সেমিকন্ডাক্টর চিপ’ শিল্পে আধিপত্য ধরে রাখতে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সেখানে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, চিপ মার্কেটের বর্তমান সম্পদ ৫০০ বিলিয়ন ডলারের কথা বলা হয়েছে, যা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাই এর সাপ্লাই চেইন নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই দুই দেশের মধ্যে যে তীব্র প্রতিযোগিতা হবে- এটাই স্বাভাবিক। কেউ এককভাবে বিশ্বে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা বেশি কষ্টকর। কারণ প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সামরিক ও কূটনৈতিক কৌশল কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশ ওপরের দিকে উঠে আসতে চাইছে যার মধ্যে চীন অন্যতম দাবীদার। ক্ষমতা বলতে বোঝায় আর্থিক সামর্থ্য, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নয়ন এবং আধুনিকায়ন যা অন্য দেশের থেকে এগিয়ে থাকে এবং উন্নত অবকাঠামোর সমন্বয়। পৃথিবীজুড়ে বহু বছর ধরে আধিপত্য বিস্তার করে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বলাইবাহুল্য, এক্ষেত্রে মার্কিন প্রযুক্তি, শক্তিশালী আর্থিকভিত্তি এবং দক্ষ রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে প্রভাব বিস্তারের প্রধান নিয়ামক যে ক্ষমতাই তা আজ না বোঝালেও চলবে। আমাদের সামাজিক পরিমণ্ডলেও যাদের ক্ষমতা বেশি তারাই প্রভাব বিস্তার করে আছে। তাদের সিদ্ধান্তই মেনে চলতে হয়। বিশ্ব পরিমন্ডলেও একই অবস্থা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এসব দেশ নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে মরিয়া। তবে সব মিলিয়ে এখন চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যেকার তীব্র প্রতিযোগিতা। বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বুহুদিন রেষারেষি থাকলেও করোনার উৎস নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং সেই উত্তেজনার পর বিশ্বের মনোযোগ ঘুরে যায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে। মার্কিন বিমান বাহিনীর শীর্ষ একজন জেনারেল মাইক মিনিহান বলেন, ২০২৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়ছে। এ জন্য তাদের লক্ষ্যের প্রতি প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। যদিও এটি তার ধারণা মাত্র। তবে দুই দেশের মধ্যে তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন সাগর ঘিরে উত্তেজনাসহ আরো কয়েকটি কারণে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে দুই দেশের নেতার সাক্ষাৎ নিশ্চিতভাবেই আশার।

তাইওয়ান বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ যেখানে চীন তাইওয়ানকে স্বাধীনভাবে দেখে না এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কোনোভাবে তাইওয়ানকে রক্ষা করতে প্রস্তুত। সুতরাং চীন যদি তাইওয়ানে সামরিক অভিযান চালায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বসে থাকবে না, এমনটাই ধারণা করা হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র এখনো যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে প্রযুক্তির শ্রেষ্ঠত্বে এগিয়ে আছে। এর মধ্যে রয়েছে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং সর্বাধুনিক যুদ্ধ বিমান। এশিয়া এবং ন্যাটোর মাধ্যমে ইউরোপে গভীর নেটওয়ার্ক বজায় রাখতে সক্ষম যুক্তরাষ্ট্র। এসব দিকে চীন পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু চীনও এগিয়ে চলেছে। শি জিনপিংয়ের সময়ে আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছে। প্রযুক্তির বাজারে এশিয়ার বাইরেও চীন টেক্কা দিয়ে চলেছে।

ভূমি, আকাশ বা সাগরে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এখন হয়তো চীন এশিয়া বা নিজের আশপাশে প্রভাব বিস্তারে মনোযোগী। ভবিষ্যতে এর বিস্তার যে আরো বৃদ্ধি পাবে না তার নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। দশকের পর দশক সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ চালানোর মধ্যে দিয়ে মার্কিন সামরিক বাহিনী পুনর্গঠিত হয়ে গেছে। তারা নতুন নতুন অস্ত্র সজ্জিত হচ্ছে। পাশাপাশি বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। এই উত্তেজনা সম্প্রতি মনে করিয়ে দিলো একটি রহস্যময় বেলুন।

কোনো বিষয়েই যে কেউ কাউকে ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়, সেটাও দেখলো বিশ্ববাসী। তবে সত্যি সত্যি এই দুই দেশের যদি যুদ্ধ হয়, তবে তা যেকোনো বিশ্বযুদ্ধকে ছাড়িয়ে যাবে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেক্ষেত্রে এই সময়ে দুই নেতার বৈঠক বৈশ্বিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে কিছুটা হলেও সম্পর্কে আলোর পথ দেখায়।

লেকখ প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত