রাশিয়ার ইউক্রেনের সামরিক অভিযানের পর থেকেই প্রশ্ন সামনে আসে যে, এই যুদ্ধ কত দিন চলবে? কারণ ইউক্রেনের প্রতিরোধ পশ্চিমা বিশ্বের সাহায্যে চলতে থাকে। এখনো সেটাই চলছে। কিন্তু কত দিন? কারণ এরই মধ্যে নতুন সংকট হিসেবে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের সামরিক অভিযান চলছে। বিশ্বের মনোযোগ এখন সেদিকে। বাস্তবতা হলো, ইউক্রেনেও সংকট চলছে এবং সেই সংকট কোনো অংশে কম নয়। জেলেনস্কি এর মধ্যেই সেই অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সবার মনোযোগ সরিয়ে নেওয়াটা ছিল রাশিয়ার লক্ষ্য। তাছাড়া পশ্চিমা বিশ্বও এখন ইউক্রেনে সাহায্যের বিষয়ে নতুন চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেছে। কারণ ইউক্রেন প্রতিরোধ যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাচ্ছে না। গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো এখন রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তিচুক্তি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বের চাওয়া অনুযায়ী রণক্ষেত্রে ইউক্রেন সাফল্য পাচ্ছে না এবং মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত হওয়ায় সম্ভবত তারা যুদ্ধ চালিয়ে নিতে ইচ্ছুক নয়। গণমাধ্যম এবিসি জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরুর পর যেসব দেশ ইউক্রেনকে সহায়তা করেছে সেগুলোর মধ্যে ন্যাটো সদস্যভুক্ত ৫০টি দেশের প্রতিনিধি গত মাসে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। আরো একটি বিষয় যে ধীরে চলো নীতি যুদ্ধে রাশিয়াকে সাফল্য এনে দিয়েছে। যুদ্ধে সমরাস্ত্র এবং মনোবল এই দুটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ। সমরাস্ত্রের ক্ষেত্রে ইউক্রেন পুরোপুরিভাবেই যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। একেবারেই নির্ভরশীল হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন। কারণ যেকোনো সময় পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে। হঠাৎ হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হওয়ায় এবং অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় বিশ্বের মনোযোগ সেদিকে ঘুরে গেছে। ঠিক এই জায়গাতেই রাশিয়া লাভবান হবে বা হচ্ছে। কারণ এত দিন যুদ্ধ বলতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানই ছিল একমাত্র যুদ্ধ।
যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সর্বোত্তভাবে ইউক্রেনের পাশে ছিল। রাশিয়ার পক্ষে জনমত তৈরিতে সক্রিয় রুশ সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার সার্গেই মারদান বলেছেন, ইসরাইলে সংঘাত বাধায় লাভবান হবে রাশিয়া। তিনি তার টেলিগ্রাম চ্যানেলে লিখেছেন, বিশ্ববাসীর নজর কিছুদিনের জন্য ইউক্রেন থেকে ঘুরে গিয়ে আবার একবার মধ্যপ্রাচ্যের আগুন নেভাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আইএসডব্লিউ বলেছে, পশ্চিমা বিশ্বকে লক্ষ করে এই বয়ান প্রচারের মাধ্যমে তিন দিক থেকে লাভবান হবে রাশিয়া। প্রথমত, ইউক্রেনে সামরিক সহায়তার দেওয়ার ব্যাপারে পাশ্চাত্যে যে জনমত রয়েছে তাতে ফাটল ধরতে পারে। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাবে বলে প্রচারের মাধ্যমে ইউক্রেনের ভেতরে হতাশা তৈরির চেষ্টা করা হবে। তৃতীয়ত, রাশিয়ার জনগণকে এই বলে আশ্বস্ত করা হবে যে আন্তর্জাতিক সমাজ ইউক্রেন যুদ্ধ উপেক্ষা করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক দেশই এই হামলার বিপক্ষে ছিল বিশেষত ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো। এখন যুক্তরাষ্ট্রের আরেক মিত্র ইসরাইলে হামাস প্রথমে হামলা চালালে ইসরাইল স্মরণকালের ভয়াবহ হামলা চালায়। সেই নৃশংসতা অব্যাহত রয়েছে। যেখানে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং বিশ্বের সব মনোযোগ হঠাৎ করেই পড়েছে সেখানে। ইউক্রেন নিয়ে কারো তেমন কোনো মাথাব্যথা দেখাও যাচ্ছে না। সুতরাং যুদ্ধ একটি স্থির পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখানে রাশিয়া সময় পাবে এবং নিজেদের মতো করে যুদ্ধজয়ের পরিকল্পনা করতে সক্ষম হবে। আর ইউক্রেন থাকবে মিত্র দেশের অস্ত্রের আশায়। কারণ এ ছাড়া তাদের যুদ্ধ অসম্ভব। এরই মধ্যে যদি ইসরাইলের সঙ্গে হামাসের যুদ্ধবিরতি কার্যকর না হয়, তাহলে যুদ্ধ আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে। যদিও সেই সম্ভাবনা কম। তবে আশার কথা হলো, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বন্ধ আলোচনায় সমাধান খোঁজা ইতিবাচক। অথচ চলতি বছরের শুরুতেই ইউক্রেন মিত্র দেশগুলোর কাছ থেকে ভারী অস্ত্র পেয়েছিল। ট্যাংক ও যুদ্ধ বিমানও দাবি করেছিল। যুদ্ধের মূল হলো অস্ত্র, যা বরাবরই ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছ থেকে পেয়েছে এবং এখনো পাচ্ছে। এভাবে আরো সামরিক সহায়তা ইউক্রেন পাবে অন্তত যতক্ষণ যুদ্ধের বন্ধের ব্যাপারে কোনো সমাধানে না পৌঁছাতে পারে।
সে ক্ষেত্রে ইউক্রেন পরাশক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো মোটামুটি জুতসই অস্ত্র পাচ্ছে এবং এর ফলে এ যুদ্ধ আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে এটা বলাই যায়। এই যুদ্ধ হচ্ছে ইউক্রেনের মাটিতেই, যুদ্ধ করছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী কিন্তু অস্ত্র, অর্থ এবং অন্যান্য জিনিসের জোগান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর প্রক্সিযুদ্ধ মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গণমাধ্যমের বিভিন্ন বিশ্লেষণে এমনটাই উঠে এসেছে। সুতরাং অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র একটি যুদ্ধ ততক্ষণ চলবে যতক্ষণ উভয় পক্ষের সম্মতিতে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে রাজি করানো যায় এবং তা আলোচনার মাধ্যমে। ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি তাদের অত্যাধুনিক ট্যাংক পাঠানোর ঘোষণা দেয়, যার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের নতুন মাত্রা শুরু হয়। মনে করা হয়েছিল, ভারী অত্যাধুনিক অস্ত্র ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর মধ্য দিয়ে তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পাবে। যুদ্ধের একেবারে শুরুতে যুদ্ধ শুরুর একটি কারণ ছিল ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তি নিয়ে, যা রাশিয়ার আপত্তির এবং উদ্বেগের বিষয় ছিল। ন্যাটোর সম্প্রসারণ রাশিয়ার উদ্বেগের কারণ। রাশিয়ার ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রথম থেকে কৌশলগতভাবে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমেই পূর্ণমাত্রায় সামরিক অভিযান শুরু করেনি। প্রথমে যুদ্ধ সম্পর্কে, যা অনুমান করা হয়েছিল তা ঠিক হয়নি। সহজেই ইউক্রেনকে দমাতে পারেনি। এর কারণ ইউক্রেনের যুদ্ধ কৌশল এবং পশ্চিমা বিশ্ব এবং মিত্র দেশগুলোর অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা। রাশিয়ার এ অভিযানে উদ্দেশ্য কী কিয়েভ দখল করা না ইউক্রেনকে ন্যাটো যোগদান থেকে বিরত রাখা- এসব প্রশ্নই থেকে গেছে। এখন পর্যন্ত রাশিয়ার যুদ্ধ কৌশল সফল হয়েছে। কিন্তু এই পশ্চিমা অস্ত্র দিয়ে কত দিন যুদ্ধ চলবে? কারণ অস্ত্রভাণ্ডারেও তো টান পরে। আবার রাশিয়ার অবস্থাও একই। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচুর অস্ত্রের দরকার হচ্ছে? কারণ যুদ্ধে জয়লাভের জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র। সেই অস্ত্র তৈরি করতেও তো সময়ের দরকার। এখনো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ইউক্রেনকে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু নিজের দেশের অস্ত্রভাণ্ডারও তো সুরক্ষিত রাখতে হবে। কারণ নিজ দেশের নিরাপত্তাই সর্বাগ্রে। যুদ্ধ না চাইলেও এখন বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। একটি যুদ্ধের বা উত্তেজনার ডামাডোলে আরেকটি ইস্যু চাপা পড়ছে অথবা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। মিয়ানমারের বিতাড়িত করা রোহিঙ্গা ইস্যুও এ রকমই একটি ইস্যু। যদিও প্রতিটি যুদ্ধই অমানবিক পরিস্থিতির জন্ম দেয় এবং অসংখ্য প্রাণ দেয়।
ইউক্রেন ইস্যুকে কেন্দ্র করে অস্ত্রের পাশাপাশি চলছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও। দুটি দেশ যুদ্ধে জড়ালেও বাস্তবিকপক্ষে এর সঙ্গে পরোক্ষভাবে অন্য দেশও জড়িত। পরস্পর নির্ভরশীল বিশ্বে কেউ কাউকে পুরোপুরিভাবে এড়িয়ে চলা প্রায় অসম্ভব। এতে যেমন ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে, তেমনি উন্নয়নশীল বিশ্ব এর ফল ভোগ করে।
এক দেশের কোনো সম্পদের ওপর অন্য এক বা একাধিক দেশনির্ভর করে। উপরন্তু সেই দুটি পক্ষ যদি হয় পরাশক্তি। সেই বহু বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে আসছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের রাজনীতি পাল্টে দিয়েছে। মাঝে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব এলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
এর আগে আলোচনার প্রস্তাবে রাশিয়ার গণভোটকৃত অঞ্চলগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার শর্ত রাখে। বিপরীতে তারা অস্ত্র সহায়তা পাচ্ছে, যা দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। কিন্তু কত দিন? যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো কত দিন, সহায়তা অব্যাহত রাখতে পারবে এবং রাশিয়াও কত দিন সময় নেবে ইউক্রেন দখল করতে। ইসরাইল-হামাসের যুদ্ধ বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকায় ইউক্রেন বিষয়টি এখন কম আলোচিত।
এই যুদ্ধের শেষটা কীভাবে হবে, সেটি জানা না গেলেও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যেভাবেই হোক যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়াটাই বিশ্ববাসীর জন্য স্বস্তির কারণ।