বাড়ছে বিয়েবিচ্ছেদ : এখান থেকে ফিরে আসা দরকার

মীর ইমরান আলী

প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিয়ে অনেকে আবেগের, অনেক স্বপ্নের ব্যাপার আবার দায়িত্বশীলতার ব্যাপারও। কারণ সংসার বাধার চেয়েও বড় কথা সংসার টিকিয়ে রাখা। বিয়ে হলে বা সংসার বাঁধলেই সব সময় হাসি-আনন্দে কাটবে তাও যেমন না, আবার সব সময় কষ্টে কাটবে তাও না। তবে ঝগড়া-ঝাটি মান-অভিমান যতই হোক, তা আবার দ্রুত ভুলে যাওয়ার মানসিকতা না থাকলে বিয়ের সুখ-বিচ্ছেদে মোড় নেবেই। বিয়ে কেন বিচ্ছেদ হয়? অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ঘরবাঁধার পড়েও কেন বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে পড়ে? সমাজবিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে বলেছেন, বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ আসলে ‘নৈতিকতার পতন’, ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’, ‘নারী-পুরুষের মনস্তাত্বিক চাপ, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধও অভাব বিয়ে বিচ্ছেদেও মূল কারণ। পুঁজিবাদেও অসম বিকামের ফলে মানুষের ভোগের বাসনা, লাইফ স্টাইলে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন ছলে-ছুতোয় তার রাগ, ঝগড়া বাড়ছে, একা থাকার মানসিকতা বাড়ছে। উচ্চাভিলাসিতা উচ্চাকাঙ্ক্ষা এত বেড়েছে যে এর ব্যত্যয় হলেই অশান্তি। তবে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা এখনো আমাদের মাথায় পুরানো ধাঁচেই টিকে রয়েছে। নারী-পুরুষের কাছে ভোগ্য পণ্য বা তার কথামতো চলবে- এমন ধারণার বাইরেও কম মানুষ আছে। আবার নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বেড়েছে। এ কারণে পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক পারিবারিক মূল্যবোধের বজ্র-আঁটুনি কাটাতে সাহস করে তারা দুই কদম বেশি স্বপ্রণোদিত হয়েছেন বলে অনুমান করা যায়। বাস্তবতা এই যে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার প্রভাবে দাম্পত্য সম্পর্কে জটিলতা বাড়বে, বিবাহবিচ্ছেদও বাড়বে এটাই স্বাভাবিক ঘটনায পরিণত হয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদ ‘মহামারির মতো’ বেড়ে যাচ্ছে। বিবাহ বিচ্ছেদ এখন স্বাভাবিক ঘটনা। ফুটফুটে সন্তান, সুন্দর সংসার, দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন, একসময়ের মধুর সম্পর্কের স্মৃতি কোনো কিছুই বিবাহ বিচ্ছেদকে আটকাতে পারছে না। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বাড়ছে। আর এই বিবাহ-বিচ্ছেদে নারীরাই এখন এগিয়ে আছেন। পৃথিবীতে মানুষের সমাজ যতদিনের পরিবারের অস্তিত্বও ঠিক ততদিনের। সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ম্যাকাইভার ও পেজ-এর মতে, পরিবার হলো- এমন একটি গোষ্ঠী, যাকে সুস্পষ্ট জৈবিক সম্পর্কের মাধ্যমে অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট করা যায়। এটি সন্তানসন্ততি জন্মদান ও লালন-পালনের এক স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নিমকফের মতে, পরিবার হলো এমন এক ধরনের স্থায়ী সংঘ, যা স্বামী-স্ত্রী সন্তানসহ কিংবা সন্তান ছাড়া অথবা সন্তানসন্ততিসহ নারী কিংবা পুরুষের দ্বারা গঠিত। সঙ্গত কারণেই একটি মধুরতম পরিবেশের বিপরীতে বিয়েবিচ্ছেদ একটি পরিবারের ভিত্তিমূল নাড়িয়ে দেয়। কখনো তা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।

সম্পর্ক যখন কিছুতেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না, তখন বিচ্ছেদই অনিবার্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বিয়ে-বিচ্ছেদের হার বাড়ছে আর এই বিবাহবিচ্ছেদে নারীরাই এখন এগিয়ে আছেন, বিচ্ছেদ কেন বাড়ছে? আর কেনইবা নারীরা এগিয়ে আছেন তা নিয়ে নানা কথা রয়েছে? প্রশ্ন উঠছে? এটা সচেতনতার ফল না কথিত আধুনিকতার প্রভাব। ঢাকার একাধিক তরুণ-তরুণীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিয়ের আগের সেই পুরুষটি বিয়ের পরে অন্যরকম হয়ে যায়- সারাক্ষণ সন্দেহ, আগের বন্ধুদের সহ্য না করা এসব নিয়ে সমস্যা তো আছেই এমনকি গায়ে হাত তুলতেও নাকি পিছপা হন না। তাই বিয়েটি ১ বছরের বেশি টেকানো যায়নি। আবার ছেলেদের অভিযোগও প্রায় একই ধরনের। স্ত্রীর অবিশ্বাস শ্বশুরবাড়ির কাউকে পছন্দ করতে না পারা, বিশাল অংকের সব বায় না। সবমিলে অশান্তি আছেই।

সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো’ এই সিদ্ধান্তে পরে সংসার ভাঙা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দু’টি এলাকায় ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তালাক কার্যকর হয় ২ হাজার ৩০৯টি, যার মধ্যে ১ হাজার ৬৯২টি স্ত্রী কর্তৃক আর স্বামী কর্তৃক ৯২৫টি ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত তালাকের সংখ্যা ৩ হাজার ৫৮৯টি? এর মধ্যে ২ হাজার ৩৮১টি স্ত্রী কর্তৃক আর স্বামী কর্তৃক হয়েছে ১ হাজার ২০৮টি। এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, তালাক দেয়া পুরুষ ৩০ শতাংশ, আর নারী ৭০ শতাংশ? নানা কারণে কিছু নারী-পুরুষ উভয়ই বিয়ের পর বিবাহবহির্ভূত রোমান্সেও জড়াচ্ছেন বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা, আর তা বিচ্ছেদ ডেকে আনছে- তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো বিশ্বাসহীনতা। বিভিন্ন গষেণায় উঠে আসছে শহরে ডিভোর্সের মধ্যে নারীরা এগিয়ে থাকলেও সেটা সারা দেশের চিত্র নয়। নিম্নবিত্তের বিয়ে বা ডিভোর্সের কোনো তথ্য নথিভুক্ত সব সময় হয় না। তবে নিম্নবিত্তের মধ্যে স্বামীরাই ডিভোর্স দিচ্ছে বেশি। সেখানে মেয়েটি সংসার টিকিয়ে রাখতে অনেক কিছু সয়ে গেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা টিকছে না এবং অনেক ক্ষেত্রে বিয়েটা ঝুলে থাকে। নানা কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসহীনতা বাড়ছে, এখন দু’জনই কাজ করছেন, বাইরে যাচ্ছেন তাদের সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতিজনের সঙ্গে মিশছেন কথা বলছেন, আর এটা যে বাইরেই তা নয়- মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এই যোগাযোগ সার্বক্ষণিক যোগযোগে পরিণত হয়। সেটা সমস্যা নয়- নয় দুজনের একজনে অন্যজনের প্রতি বিশ্বাস, সম্মান ও ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ থাকে ও ত্যাগের মানসিকতা থাকে। বিবাহবিচ্ছেদ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এটা একটা সমাজকে অস্থিরেও করে তোলে এই অস্থিরতা থেকে ফিরে আসা দরকার।