বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরানোর আশা জাগছে

মো. তাঈদ উদ্দিন খান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অনেকদিন পর খুশি হওয়ার মতো একটি খবর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীর বর্তমান অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে এবং কানাডার একটি টিভি চ্যানেল দীর্ঘ ৭ মাস এই খুনিকে অনুসরণ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি প্রচার করেছে দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সিবিসি। টেলিভিশনটির অনুসন্ধানী বিভাগ ‘দ্য ফিফথ স্টেট’ এ ‘দ্য অ্যাসাসিন নেক্সট ডোর’ শিরোনামের ৪২ মিনিটের এই প্রতিবেদনটি প্রচারিত হয় বাংলাদেশ সময় শুক্রবার মধ্য রাতে। প্রতিবেদনে টরন্টোর নিজ ফ্লাটের ব্যালকনিতে নূর চৌধুরীকে দেখানো হয়। এ ছাড়া গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নূর চৌধুরীকে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা অবস্থায় দেখা যায়। কিন্তু প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা না বলে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে যান তিনি। দীর্ঘদিন অনুসরণ করে তাকে খুঁজে বের করেছে ফিফথ স্টেটের অনুসন্ধানী দল। কানাডার টরন্টো থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরের এলাকা ইটোবিকো।

সেখানে একটি কনডোমিনিয়ামের তিন তলায় থাকেন ৭০ বছর বয়সি বঙ্গবন্ধু হত্যার এই খুনি। প্রতিদিন বিকালে ব্যালকনিতে আসেন। কানাডায় মুক্তভাবে জীবনযাপন করলেও প্রথমবারের মতো তার দেখা পাওয়া গেল ক্যামেরায়। নূর চৌধুরীর কানাডায় পলাতক থাকা এবং খুনের দায়ে সাজা বাস্তবায়নে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয় প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কানাডা খুনিদের মানবাধিকার দেখছে; কিন্তু আমার বা আমাদের স্বজনদের মানবাধিকার দেখছে না। কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার বলেছেন, এই একটি ইস্যু বাদে কানাডার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। শুধু বাংলাদেশি হাইকমিশনার হিসেবে নয়, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি চাই তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হোক। প্রাক্তন কানাডীয় বিরোধী দলীয় নেতা ও মন্ত্রী স্টকওয়েল ডে বলেছেন, এটি ৫০ বছর আগের ঘটনা হলেও সুরাহা হওয়া উচিত। প্রতিবেদনটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলার আইনজীবী ও বর্তমান আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক, তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দের বরাতে ও বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের মাধ্যমে দেখানো হয়, কীভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল নূর চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যার পর বিভিন্ন দেশে কূটনীতিকের চাকরি করেন নূর।

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে হংকং থেকে পালিয়ে কানাডায় চলে যান। ২০০৬ সালে শরণার্থী আবেদন নাকচ করে তাকে দেশত্যাগের নির্দেশ দেয় কানাডা। কিন্তু দেশে ফিরলে মৃত্যুদণ্ড হবে জানিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি মূল্যায়নের আবেদন জানান। কানাডার মৃত্যুদণ্ডবিরোধী অবস্থানের এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেখান অবস্থান করছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ দায়েরকারী হিসেবে বলছি এবং বদ্ধমূল বিশ্বাস রাখছি, প্রতিবেদনটি প্রচারিত হওয়ার পর ঘাতকের প্রতিবেশিরা সজাগ হবে বলে আমার বিশ্বাস।

বিগত ১৪ বছরে কয়েক দফায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় খুনিকে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। পলাতক আছে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আরো পাঁচজন। তারা হলো আবদুর রশীদ, রাশেদ চৌধুরী, শরীফুল হক ডালিম, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন এবং নূর চৌধুরী। প্রথম তিনজনের অবস্থান অজ্ঞাত। মোসলেহউদ্দিন ভারতে পলাতক আছে বলে কয়েকবার রটনা প্রকাশিত হলেও পরে আর কিছু জানা সম্ভব হয়নি। আর নূর চৌধুরী কানাডায়- সেটি সবাই জানেন। কিন্তু বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকায় কানাডা নূরকে হস্তান্তর করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল। তবে কানাডার আইনের একটি উপধারায় বলা আছে অপরাধী যদি ঘোরতর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনে অভিযুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে পারে। আমরা জানি যে ২০০৪-২০০৮ এই দীর্ঘ সময়ে কানাডা নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সরকার এবং ১/১১ সরকার কোনো এক অজ্ঞাত কারণে নূরকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না। এ ছাড়া একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খন্দকার মোশতাকের পালক-পুত্র রফিক আহমেদ কানাডায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করায় বন্দি প্রত্যার্পণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। তবে কানাডার টিভি চ্যানেলে প্রচারিত প্রতিবেদনের পর আমরা আশাবাদী যে নূর চৌধুরীকে আমরা অদূর ভবিষ্যতে পেতে যাচ্ছি। দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করাও সম্ভবপর হবে। আমরা এরই মধ্যে জানতে পেরেছি যে আমাদের মান্যবর রাষ্ট্রদূত খলিলুর রহমান কানাডা সরকারের সঙ্গে নূর চৌধুরীর বিষয়ে নিবিড় যোগাযোগ রাখছেন।

সবশেষ সিবিসি চ্যানেলের সংবাদ কর্মীদের ধন্যবাদ এমন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করায়। বলা প্রয়োজন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর পরবর্তী সরকারগুলো এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার তো করেইনি বরং বিচার বন্ধে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। সে কারণে বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত।

সাংবিধানিকভাবে বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা। তাই জাতির পিতার সন্তান হিসেবে হৃদয়ের তাগিদ থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগপত্রটি দায়ের করেছিলাম।

ঘটনাটি ৩১ আগস্ট ১৯৯৬ সালের। রাজশাহী আইন কলেজের তখনকার ছাত্র আমি তাঈদ উদ্দিন খান এবং আমার বন্ধু মোহসিনুল হক ধানমণ্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং শাস্তির আওতায় আনার অনুরোধ জানিয়ে একটি মামলা দায়েরের উদ্দেশ্যে এজাহার করি। ধানমণ্ডি থানা এজাহারটি গ্রহণ করলেও তেমন অগ্রগতি চোখে পড়েনি। সে সময়ের সব পত্রিকা এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে এই ঘটনা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়। এমনকি কিছুদিন আগেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আবদুল মান্নান ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই ঘটনার উল্লেখ করেন। এ ছাড়া অধ্যাপক ড. নীলিমা ইব্রাহিম এক বক্তৃতায় এই ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন।

সেদিন আমরা ধানমণ্ডি থানায় যে অভিযোগপত্রটি দায়ের করেছিলেন, সেটি শুধু সাদামাটা একটি অভিযোগপত্র ছিল না। বাংলাদেশের সংবিধানের নানা অনুচ্ছেদের চুম্বক অংশ তুলে ধরে আমরা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলাম যে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ডটি ছিল গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোনো সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দিকে আটক, ফৌজদারিতে সোপর্দ কিংবা দণ্ডদান করার বিধান সংবলিত কোনো আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস বা তাহার পরিপন্থি, এই কারণে বাতিল বা বেআইনি বলিয়া গণ্য হইবে না কিংবা কখনো বাতিল বা বেআইনি হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে না।

সংবিধানের প্রস্তাবনার চতুর্থ প্যারাতে বলা হয়েছে- আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তার সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রতি প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। সংবিধানের এরকম অনেক উদ্ধৃতি ব্যবহার করে লিখিত হয়েছিল অভিযোগপত্রটি। অভিযোগপত্রে অনেক সেনা কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হয়। তাই দাবি ও অধিকার নিয়ে বলছি- আমি চাই পলাতক সব আসামিকে দেশে ফিরিয়ে এনে এই রায় শতভাগ কার্যকর করতে হবে। মানবাধিকারের দোহাই তোলা যেসব দেশ বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের আশ্রয় দিয়েছে; তাদের কাছে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার অনুরোধ তারা যেন খুনিদের বাংলাদেশের আইন ও বিচার বিভাগের কাছে ফিরিয়ে দেয়। অভিযুক্ত সব খুনির শাস্তি কার্যকর করতে পারলেই বাংলাদেশ অভিশাপ মুক্ত হবে। আশা করি সেই পথ সুগম হবে; অন্তত নূর চৌধুরীর অবস্থান শনাক্ত হওয়া আমাদের আশা দেখাচ্ছে।

লেখক : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ দায়েরকারী। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।