ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্বার্থ যখন সামনে এসে দাঁড়ায় মানবতা তখন পালিয়ে বেড়ায়

রায়হান আহমেদ তপাদার, গবেষক ও কলামিস্ট, [email protected]
স্বার্থ যখন সামনে এসে দাঁড়ায় মানবতা তখন পালিয়ে বেড়ায়

গত সাত দশক ধরে ফিলিস্তিনে দখলদার ইসরাইলিদের বন্দুক-বোমার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে আছে এই শিশুরা। এই সাত দশকে সাতটি প্রজন্মের এমন হাজারো শিশু ঝরে গেছে। কিন্তু গাজাবাসী জানে তারা নিজে মরলেও জাতিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। তাই ধ্বংসপ্রায় ফিলিস্তিনি জাতিকে টেকাতে, অজস্র মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শহিদদের শূন্যস্থান ভরাটের জন্য আরো সন্তানের জন্ম দিয়ে চলে তারা। তাতেও সংকুচিত হয়ে আসে বংশগতির ধারা। ৭ অক্টোবর ইসরাইল ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর গত ১ মাস ধরে গাজায় তীব্র বোমাবর্ষণ করে চলেছে ইসরাইল। ইসরাইলের হামলায় গাজা উপত্যকায় নিহতের সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়েই চলেছে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, নিহতদের এক-তৃতীয়াংশই শিশু। মানবাধিকার সংগঠন ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল ফিলিস্তিনের (ডিসিআইপি) হিসাবে, এ পর্যন্ত ইসরাইলি বিমান বাহিনীর অব্যাহত হামলায় গাজা উপত্যকায় গড়ে প্রতি ১৫ মিনিটে একজন করে শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। গাজার আল শিফা হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ঘাসান আবু সিত্তাহও বিবিসিকে জানিয়েছেন, ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা আহতদের ৪০ শতাংশই ছিল শিশু। পরিবারের সব সদস্যকে হারানো এমন কিছু শিশুর কথা জানাতে গিয়ে এই চিকিৎসক আবেগঘন এক পোস্টে লেখেন, ‘যে শিশুটিকে দেখাশোনা করার জন্য কেউ থাকল না, তার জন্য এই মহাবিশ্বে হাসপাতালের বিছানার মতো এমন নিঃসঙ্গ জায়গা আর নেই।’ গাজা উপত্যকায় শিশুদের বয়স পরিমাপ করা হয় তারা কতগুলো ইসরাইলি হামলার শিকার হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে। গাজার ২৩ লাখ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বয়স ১৮ বছরের কম এবং বর্তমান আক্রমণটি গত ১৫ বছরের মধ্যে ইসরাইলের পঞ্চম ও সবচেয়ে বড় আক্রমণ। সেভ দ্য চিলড্রেনের ২০২২ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, গাজায় প্রতি পাঁচ শিশুর মধ্যে চার শিশু বিষণ্ণতা ও ভয়ের মধ্যে বাস করছে। এখানকার অর্ধেকেরও বেশি শিশু আত্মহত্যার কথাভাবে এবং অন্য শিশুদের মৃত্যুর সাক্ষী হওয়ার ট্রমা নিয়ে বেঁচে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে গাজায় ইসরাইলের চলমান হামলায় শত শত নারী ও শিশুর প্রাণহানির ঘটনায় গত ১৪ অক্টোবর যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায় ইউনিসেফ। এদিকে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউ-এর এক বিবৃতিতে বলা হয়, গত কয়েক সপ্তাহে গাজার বেশ কয়েকটি পানি শোধনাগার বন্ধ হয়ে গেছে। এদিন দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকার বাসিন্দারা মাত্র তিন ঘণ্টার জন্য পানি পেয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের ফিলিস্তিন কার্যালয়ের পরিচালক জেসন লি’র ভাষ্য, পানির প্রবাহ ও গাজার শিশুদের জীবন এখন একই সূত্রেগাঁথা। যুদ্ধের অবসান বা যুদ্ধবিরতি না হলে হাজারো শিশুর প্রাণহানি হবে। গত ২৩ বছরে ২৩০১ ফিলিস্তিনি শিশু নিহত ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল প্যালেস্টাইনের (ডিসিআইপি) হিসাব অনুসারে। ২০০০ সাল থেকে চলতি আগ্রাসনের আগ পর্যন্ত ইসরাইলি বাহিনীর হাতে নিহত ফিলিস্তিনি শিশুর সংখ্যা ২ হাজার ৩০১। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে ২০১৪ সালে। অধিকৃত পশ্চিম তীরে তিন ইসরাইলি কিশোরকে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে সে বছর ৮ জুলাই থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত ৫০ দিন গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান চালায় ইসরাইলি বাহিনী। অপারেশন প্রোটেকটিভ এইজ নামে পরিচিত ওই অভিযানে ২ হাজার ২৫১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন, যাদের মধ্যে ৫৫১ জনই ছিল শিশু। নারী ছিলেন ২৯৯ জন। মৃত্যু উপত্যকায় জন্মের অপেক্ষায় ৫০ হাজার শিশু ইসরাইলি বাহিনীর নির্বিচার বোমাবর্ষণের মধ্যেই মধ্য গাজার আল-আহলি আরব নামের হাসপাতালে এক নজিরবিহীন হামলায় অন্তত ৫০০ মানুষ নিহত হন। এর আগে ইসরাইলি হামলায় আহত শত শত রোগী ও গৃহহীন অসংখ্য বাসিন্দা নিরাপদ ভেবে ওই হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই হামলার পর জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অফিসের মুখপাত্র সেলিম ওয়েইস এক বিবৃতিতে বলেন, গাজার কোনো জায়গাই এখন শিশু ও তার পরিবারের জন্য নিরাপদ নয়। হাসপাতালে হামলার ওই ঘটনাকে ভয়াবহ ও অগ্রহণযোগ্য অভিহিত করে এর তীব্র নিন্দা জানান তিনি। এমন পরিস্থিতিতেও বোমা-বারুদে মাটিতে মিশে যেতে থাকা এই উপত্যকায় অন্তত ৫০ হাজার নারী সন্তান জন্ম দিতে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)। ডিসিআইপির হিসাবে ২০১৮ সালে ৫৬ ফিলিস্তিনি শিশু ইসরাইলি সেনাদের হাতে নিহত হয়। কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে সংগঠনটি জানায়, টার্গেট হওয়া শিশুগুলো ছিল নিরস্ত্র। তারা ইসরাইল বা এর নাগরিকদের জন্য কোনো ধরনের হুমকিও তৈরি করেনি। এদের মধ্যে পাঁচ শিশুর বয়স ছিল ১২ বছরের নিচে। তখন এ সংক্রান্ত এক নিবন্ধে লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যম-পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট মনিটরের রামোনা ওয়াদি লেখেন, ফিলিস্তিনি শিশু হত্যা বা জখম করার মাধ্যমে এমন একটি প্রজন্মকে পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে, যারা উপনিবেশবিরোধী লড়াই চালু রাখতে পারে। একইসঙ্গে মনে পড়ে ৮ বছর আগে যুদ্ধের তাড়া খেয়ে তুরস্কের উপকূলে ভেসে ওঠা সিরীয় শরণার্থী শিশু আয়লান কুর্দির মুখ। তাই বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ছাদখোলা কারাগারে জীবন-মৃত্যুর অঙ্ক কষতে থাকা ফিলিস্তিনিরা মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় মরণ অবধারিত জেনেও গুলতি কিংবা পাথর হাতে সটান দাঁড়িয়ে যান ভয়াল ট্যাঙ্কের সামনে। দুই দেশের অধিকাংশ মানুষই এই সংঘাত নিরসনে অন্য যেকোনো পরিকল্পনার তুলনায় দুই-জাতি পরিকল্পনাকে বেশি সমর্থন করে। অধিকাংশ ফিলিস্তিনি মনে করে, তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র হওয়া উচিত পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকাকে কেন্দ্র করে। অধিকাংশ ইসরাইলিও এই ধারণা সমর্থন করে। হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন শিক্ষাবিদ সবকিছু বাদ দিয়ে একটিমাত্র রাষ্ট্র গঠনকে সমর্থন করে। তাদের মতে সমগ্র ইসরাইল, পশ্চিমতীর ও গাজা মিলে একটি দ্বিজাতীয় রাষ্ট্র গঠিত হওয়া উচিত, যেখানে সবার সমান অধিকার থাকবে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে ইসরাইল বহুকাল ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর যে ধরনের হামলা চালিয়ে আসছে তাতে সারা বিশ্ব চুপ। কারো যেন কিছু বলার ছিল না। ফিলিস্তিনিরা পাথর মেরে ঠেকাতে চেয়েছে ইসরাইলি আগ্রাসন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত