সামাজিক অবক্ষয় বাল্যবিবাহ বাড়ছে কেন!

অ্যাডভোকেট. মো. রায়হান আলী

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ের ঘটনাগুলো সমাজে ক্রমেই বাড়ছে। আইনে বাল্যবিবাহ অপরাধ হলেও যেন তোয়াক্কা করছে না অনেকেই। সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে বাল্যবিবাহ। এত সচেতনতা, এত কঠোরতা কোনো কিছুতেই থামছে না এই সামাজিক ব্যাধিটি। শিশু আইন, শিশু নীতিসহ বিভিন্ন আইন ও নীতি এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদসহ বিভিন্ন সনদ অনুসমর্থন করে সরকার ১৮ বছরের কম বয়সিদের শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ অনুযায়ী, ছেলেদের বিয়ের বয়স-২১ এবং মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ করা হয়েছে। এই বয়সের আগে বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া কেউ বিয়ে করলে তা হবে অপরাধ। এ অপরাধকারী ব্যক্তি ২ বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থ বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। বাল্যবিয়ের সঙ্গে জড়িত পিতামাতা বা অভিভাবকরা যদি বিয়ের অনুমতি প্রদান করেন অথবা বিয়ে বন্ধ করার জন্য ব্যর্থ হন, এমনকি বাল্যবিবাহ অনুষ্ঠান বা পরিচালনাকারীও এই একই সাজার আওতাভুক্ত হবেন। এ ছাড়াও কোনো বিবাহ নিবন্ধক বাল্যবিবাহ নিবন্ধন করিলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ বছর ও অন্যূন ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং তাহার লাইসেন্স বা নিয়োগ বাতিল হইবে। এসব সাজা মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ অনুযায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রদান করবেন।

এমন আইনের কঠোর বিধান থাকা সত্ত্বেও একদল অসাধু নিকাহ্ রেজিস্ট্রার বা কাজী অসদুপায় অবলম্বল করে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কৌশলে বাল্যবিবাহ রেজিস্ট্রেশনের নামে জনসাধারণকে প্রতারিত করছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সবকিছু বিবেচনা করেই মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর করা হয়েছে। কাজেই ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ে নিবন্ধন না করতে কাজিদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ৩১ আগস্ট, ২০২২ তারিখে আমার সংবাদ পত্রিকার রিপোর্টে তুলে ধরেছেন, ‘শামসুল ইসলাম বাবুল। চট্টগ্রাম নগরের মিসকিন শাহ মসজিদের আশপাশ এলাকায় ২০ বছর ধরে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রির কাজ করেন। প্রতি মাসে তিনি অন্তত ৩০টি বিয়ে ও তালাক ‘রেজিস্ট্রি’ করেন। সে হিসাবে গত ২০ বছরে ৭ হাজারের বেশি বিয়ে ও তালাক ‘রেজিস্ট্রি’ করেছেন। তবে চট্টগ্রাম মহানগরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজীদের তালিকায় শামসুল ইসলাম বাবুল নামে কারো নাম নেই। তাকে কি, কাজী হিসেবে প্রায় দুই যুগ কাজ চালিয়ে আসছেন বাবুল। মাজার এলাকার রাশেদুল বারি নামের এক ব্যক্তি বলেন, প্রতি শুক্রবার মাজারে তিন থেকে চারটি বিয়ে হয়। বেশিরভাগ বিয়ে হয় আসরের নামাজের পর। এছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিনও কম-বেশি বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন হয়। সবগুলো বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি করেন বাবুল। এক চট্টগ্রামেই যদি এই হাল-হকিকত হয়, তাহলে সারা দেশের অবস্থা কেমন হতে পারে!

‘রাজশাহী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় ও রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ২০১৫ সালে ৪৬ হাজার ৩২৪ শিক্ষার্থী পিইসি (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায়) উত্তীর্ণ হয়েছিল। এই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালে জেএসসি পরীক্ষায় বসতে বসতেই তাদের মধ্যে থেকে ৭ হাজার ৭ জন শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ে। পরীক্ষা দেয় ৩৯ হাজার ৩১৭ জন শিক্ষার্থী। ২০২১ সালে তারা এসএসসি পরীক্ষা দেয়। এই পরীক্ষার সময় আরো ৬ হাজার শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এতে পাঁচ বছরে জেলায় ১৩ হাজার ৭ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে, যা মোট শিক্ষার্থীর ২৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এ নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে রাজশাহী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিনের সঙ্গে’। ( সূত্রঃ প্রথম আলো, ৮ সেপ্টেম্বর,২০২২)। গণমাধ্যমের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ৭ হাজার ৯০০ জন কাজী রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় রয়েছেন ২৩১ জন। শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশনে এলাকায় রয়েছেন ১২৯ জন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই তালিকার বাইরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেসব কাজী রয়েছেন তারা অবৈধ। এ সংখ্যা প্রায় ৪০০। তাদের কোনো নিবন্ধনপত্র নেই। রাজধানীতে কয়েকটি এলাকা বড় হওয়ায় সেখানে একের অধিক কাজী রয়েছেন। ঢাকা জজকোর্ট, রামপুরা, বসুন্ধরা, মগবাজার, মালিবাগ, মহাখালী, উত্তরা, ফার্মগেট, সায়েদাবাদসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছেন অগণিত ভাসমান কাজী।

তাদের কোনো বৈধ সনদ বা ঠিকানা নেই’। রাজধানীসহ সারা দেশে এমন অপরাধে সহজ-সরল মানুষদের সবচেয়ে বেশি প্রলুব্ধ করছে ভুয়া কাজীরা। ভুয়া কাজীদের সামান্য সাজার ব্যবস্থায় তারা হয়তো বা বিষয়টি আমলে না নিয়ে তাদের অপকর্মের দৌরাত্ম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে করে বেশিরভাগ অসচেতন মানুষ ভিক্টিমাইজ হচ্ছে। ভুয়া কাবিননামায় বিয়ে-তালাক হওয়ার ফলে ভুক্তভোগীরা হারাচ্ছে তাদের আইনগত অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, দাম্পত্য অধিকারসহ অন্যান্য অধিকারগুলো। প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, ‘সরকারের ২০২১ সালের সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) বলছে, ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ১৯ বছরের মধ্যে প্রতি তিনজনের একজন কিশোরী গর্ভধারণ করছে বা সন্তানের জন্ম দিচ্ছে। গত জুলাই মাসে জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ ও যুক্তরাজ্য সরকারের যৌথ আয়োজনে ২১ থেকে ২৩ জুলাই লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছর বয়সের আগে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়েছিলেন’।