দক্ষিণ এশিয়ার পানি সংকট

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বে পানি সংকট ভবিষ্যতে চরম আকার ধারণ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সংকটে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের অন্য যে কোনো জায়গার চেয়ে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে পানি সংকট দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশুরা এর ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে। জলবায়ু পরিবর্তন আবহাওয়ার সংকট এবং বৃষ্টিপাতকে ব্যাহত করছে। এ কারণেই পানি সংকট আরো বাড়ছে। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তান, ভারত, ভুটান, বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় বিশ্বের এক চতুর্থাংশেরও বেশি শিশু রয়েছে। এসব দেশে ১৮ বছরের কম বয়সি ৩৪৭ মিলিয়ন শিশু ব্যাপক বা অতি ব্যাপকভাবে পানির ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে। সংখ্যার দিক থেকে এটি অন্য অঞ্চলের চেয়ে সর্বোচ্চ। এর আগে দক্ষিণ এশিয়ার ৪৫ মিলিয়ন শিশুর মৌলিক খাবার পানীয়ের অভাব ছিল। সেটিও বিশ্বের অন্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের (ডব্লিউআরআই) দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ মানুষ এ মুহূর্তে পানির চরম সংকটের মধ্যে দিন যাপন করছে। ডব্লিউআরআইয়ের অ্যাকিউডাক্ট ওয়াটার রিস্ক ম্যাপ থেকে প্রকাশ পেয়েছে, পৃথিবীজুড়েই পানির চাহিদা বাড়ছে। এবং ১৯৬০ সালের পর থেকে এ চাহিদা দ্বিগুণ বেড়েছে। বিশ্লেষণ বলছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ বছরে অন্তত এক মাস পানির তীব্র সংকটে ভোগেন; এ সংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। ২০৫০ সাল নাগাদ এটি বেড়ে দাঁড়াবে ৬০ শতাংশে।

অ্যাকিউডাক্ট বলছে, বৈশ্বিক জিডিপির ৩১ শতাংশ বা ৭০ ট্রিলিয়ন ডলার পানির সংকটের মুখে পড়বে, যা ২০১০ সালে ছিল ২৪ শতাংশ। প্রতিদিন পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর খাদ্যের পাশাপাশি যা আবশ্যকীয় তা হলো পানি। এক-দুইবেলা খাদ্য না খেয়েও দিব্বি মানুষ বেঁচে থাকছে কিন্তু পানি ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। প্রাণের উৎস পানি। এক ফোঁটা পানির তৃষ্ণার সময় সব খাবার অপ্রয়োজনীয়। পানি হতে হবে সুপেয়। কারণ সুপেয় পানির বাইরে যে পানি রয়েছে তা পান অযোগ্য এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকির। পানির অস্তিত্ত খোঁজার জন্য বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বাইরে চাঁদ ও মঙ্গলে অভিযান চালাচ্ছে। কারণ পানির সন্ধান পেলেই সেখানে প্রাণের খোঁজ মেলা সম্ভব। পৃথিবীর পরবর্তী মানুষের বাসস্থান এসব গ্রহ হতে পারে যদি সেখানে পানি পাওয়া যায়। আমাদের এই ভূমণ্ডলের বেশিরভাগ অংশই পানি হলেও খাওয়ার উপযোগী পানির পরিমাণ কম। সেই কম থেকে আরো কমে আসছে। নিরাপদ পানির উৎসস্থল ক্রমেই আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসছে।

বিশ্বজুড়ে পানির অপচয় রোধের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন জানিয়েছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ এখন পর্যন্ত নিরাপদ সুপেয় পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আর মৌলিক পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য নিয়মিত পানির নিশ্চয়তা নেই শতকরা হিসাবে এমন মানুষের হার ৪৬ শতাংশ। সংখ্যার হিসাবে বর্তমানে বিশ্বে ২০০ কোটিরও বেশি মানুষের নিশ্চয়তা নেই। সেখানে আরো বলা হয়, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব মানুষের জন্য নিরাপদ সুপেয় পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় পানির নিশ্চয়তা চায় জাতিসংঘ।

গবেষকরা বলছেন, দ্রুত বরফ গলার কারণে আগামী ৪০ বছরের মধ্যে পুরোপুরি ভেসে যাবে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেকংসহ প্রধান দশ নদী ও তাদের অববাহিকাগুলো। ফলে পানির জন্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে এই অঞ্চলের বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, চায়না, আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া, ভুটানসহ আট দেশের মানুষ। ২০৩০ সাল নাগাদ পানির অভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ধান, গম ও ভুট্টার ফলন ১০ শতাংশ কমে যাবে। পানির অভাবে এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে। আবার ইউনিসেফের অন্য এক তথ্য অনুযায়ী, নিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই এমন ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

পানির তীব্র সংকটে যারা রয়েছে এর অধিকাংশই দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। সারা বিশ্বেই এই এক চিত্র। অথচ পানির অপচয় কমাতে পারলে এবং সুষ্ঠু বণ্টন করতে পারলে এই দরিদ্র্র শ্রেণির অনেককেই পানি থেকে বঞ্চিত হতে পারে না। আমাদের দেশে বৃষ্টি বা এরকম উৎস থেকে যে পানি আসছে তার অধিকাংশই নষ্ট হচ্ছে। অর্থাৎ তা মাটিতে ফিরে যেতে পারছে না। অধিকাংশ নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে পানির সংকট ঘনিভূত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, সারা বিশ্বে যে পরিমাণ পানি রয়েছে তার মধ্যে মাত্র .০১৪ ভাগ খাবার পানি রয়েছে। নিরাপদ পানির জন্য বাজারের বোতলজাত পানি কিনে খাওয়া আজ একটি সাধারণ দৃশ্য। সেই বোতলজাত পানিই যে নিরাপদ তার নিশ্চয়তাও বা কীভাবে পাই! কারণ মাঝে মধ্যেই অসাধু ব্যবসায়িদের বোতলজাত পানির নামে অনিরাপদ পানি ভরে বিক্রি করার খবর পাই। এসব বাদে এটি নিরাপদ এবং পানযোগ্য। কিন্তু কতজনের এই পানি বাজার থেকে কিনে খাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে? আর থাকলেও কতবার?

পানি মানুষের জীবন জীবিকা ও উন্নয়নের সব বিষয়ের অত্যাবশ্যক উপাদান। তাই পানির সঠিক হিসাব হওয়া উচিত। মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হলে পানির ন্যায্য হিসাব একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। বাংলাদশের জীবন জীবিকা ও সংস্কৃতিতে পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের কষিকাজ, শিল্পকলকারখানা, মৎস্য চাষ, জলজ সম্পদের আরোহন থেকে শুরু করে আমাদের ঐতিহ্য এর সাথে জড়িত। বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই পানির সংকটের ব্যাপারে সতর্ক করে আসছে। আমাদের দেশে কেবল রাজধানী ঢাকা শহর নয় বরং প্রধান প্রধান বিভাগীয় শহরগুলোতেও শুকনো মৌসুমে পানির তীব্র সংকট দেখা যায়। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায় এবং নলকূপ দিয়ে পানি ওঠে না। উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এই সমস্যা আরো তীব্র হচ্ছে। যখন বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ কেবল পানির জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় একত্রিত হবে সেদিনটা হবে ভয়াবহ। কারণ একফোঁটা পানি অন্য সব খাদ্যের চেয়ে বহুগুণে মূল্যবান। পানযোগ্য পানির অপর নামই যে জীবন। মানুষ আজ তেল, গ্যাস বা এরকম প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য যুদ্ধ করছে। এমন একসময় আসতে পারে যখন পানির দখলের জন্য প্রচেষ্টা শুরু হবে। কারণ শুকনো গলায় তো আর যুদ্ধ হয় না। তাই আগে পানি তারপর সবকিছু। যা আমাদের জীবন ও জীবিকার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। সারা বিশ্বের অনেক বড় বড় শহর আজ পানির তীব্র সংকটে ভুগছে। কয়েকটি শহর তো রীতিমতো পানিশূন্য হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছে।

আমাদের দেশেও সুপেয় পানি পান না বহু সংখ্যক মানুষ। এসডিজির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাত্র ৫৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছেন। বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় পাঁচ হাজার শিশু মারা যায় সুপেয় পানির অভাবে। পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। রাজধানীবাসীর ব্যবহৃত ৮৬ শতাংশ পানিই ভূগর্ভস্থ পানি। গরমের সময় এই সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করে। ক্রমেই ঢাকার আশপাশের নদনদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়াতে এবং তার সাথে পানি সংরক্ষণের কোনো সুবিধাজনক উপায় না থাকায় গত কয়েক বছরে পানির স্তর নষ্ট হচ্ছে।

কোনো সুপেয় পানির অভাব তার পেছনে অপরাপর বেশ কিছু কারণ জড়িত রয়েছে। আমাদের জনসংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বেড়ে চলার সাথে সাথে নদীনালা ভরাট হচ্ছে। নদীনালা খালবিল ভরাট হওয়ার সাথে সাথে নিরাপদ পানির উৎস নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি দ্রুত জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে দ্রুত নগরায়ণ ঘটছে। কৃষিজমি ভরাট হয়ে গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা। এসব শিল্পকারখানার বিষাক্ত পদার্থ নদীতে পড়ার ফলে দূষিত হচ্ছে পানি। তাছাড়া বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য পানির যোগান দেওয়া কর্তৃপক্ষের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

ভুগর্ভস্থ পানি আমাদের দেশে ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে। মোট কথা পানির জন্য আমরা মাটির নিচে সঞ্চিত পানি ব্যবহার করছি। অনেক দেশেই বৃষ্টির পানি ধরে তা সারাবছর ব্যবহার করছে তারা। পানি নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব ও সমস্যার সমাধান সঠিকভাবে না করতে পারলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটা অস্বাভাবিক হবে না। তার কারণও রয়েছে।

তেল, গ্যাসের বিকল্প শক্তি আবিষ্কারে মানুষ ক্রমাগতই সাফল্যের মুখ দেখছে। কিন্তু সুপেয় পানির যোগান ক্রমেই কমে আসছে। সর্বোপরি পানি সম্পদ রক্ষার জন্য বৈশ্বিক পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা জরুরি।