গাজা এখন নিষ্পাপ শিশুদের কবরস্থান

ইলিয়াস হোসেন রানা

প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গাজায় ইসরাইলের বর্বরতা চলমান। জাতিসংঘ জানিয়েছে, সেখানে আর কোনো জায়গাই নিরাপদ নেই। জাতিসংঘের ফিলিস্তিন শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার পরিচালক টমাস হোয়াইট মন্তব্য করেছেন, সেখানকার বাসিন্দাদের বাঁচাতে জাতিসংঘের প্রায় কোনো কিছুই করার নেই। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানিয়েছে, গাজা এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপ। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ফিলিস্তিনি মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। এদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই নারী ও শিশু (৪ হাজার ৫০০ হাজারের বেশি শিশু, ৩ হাজার ৫০০ নারী নিহিত হয়েছে)। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ৬ জন শিশু নিহিত হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, ‘গাজা এখন শিশুদের কবরস্থান। ঘুমন্ত শিশুদের ওপর হামলার চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছুই হতে পারে না।’ সাবেক আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ওবামাও নাকি গাজায় ক্রমবর্ধমান নারী-শিশুর মৃত্যুতে খুবই উদ্বিগ্ন। তা সত্ত্বেও তারা কেউ ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটা কড়া ব্যবস্থা নিতে পারে না। রূপকথার গল্পের বাঁদরের কলজে যেমন গাছের মগডালে বাঁধা থাকে, তেমনি মনে হয়, এদের কোনো একটা স্বার্থ ইসরাইলিদের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। জাতিসংঘসহ সব সংস্থা আশঙ্কা করছে, নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। এখন একটা মাইলফলক চোখের সামনে স্পষ্ট। জাতিসংঘের হিসেবে গত ২১ মাসে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে প্রায় ৯ হাজার ৭০০ জন ইউক্রেনীয় বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে। ফিলিস্তিনদের কিছু মৃত্যুর মধ্যে হয়তো হামাসও আছে। কিন্তু সেটা যদি সর্বোচ্চ ১০ শতাংশও হয়, যেটার সম্ভাবনা খুবই কম, তারপরও দেখা যায় রাশিয়া ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে যত জনকে হত্যা করেছে ইসরাইলিরা ঠিক সেই পরিমাণ বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে গত ১ মাসের মধ্যে। জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস বলছে, ইসরাইলি বিমান হামলায় এত বেশি বেসামরিক নাগরিক মারা যাচ্ছে বা আহত হচ্ছে যে, তারা মনে করছে এই হামলাগুলো খুব বিশৃঙ্খলভাবে করা হচ্ছে, যা যুদ্ধাপরাধের শামিল। ফিলিস্তিনির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজায় ৬০০ পরিবার আছে যাদের কোনো সদস্যই পৃথিবীর বুকে নেই। নাগরিক নিবন্ধন তালিকা থেকে তাদের নাম মুছে দেওয়া হয়েছে। যে হাসপাতালে বাঁচার জন্য আহতরা চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে, সেখানেও হামলা করছে দখলদার বাহিনী। আলজাজিরার বিশ্লেষণ অনুসারে, ইসরাইল এখন পর্যন্ত গাজায় শুধু বোমা ফেলতেই কমপক্ষে ২০০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। এক পরিসংখ্যান অনুসারে, ইসরাইল ১২০০০ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে এবং ৩০০০০ টন বোমা ফেলেছে। প্রায় ৬৫ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। ২৩ লাখ জনসংখ্যার গাজার ৭০ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ইসরাইলি হামলায় গাজায় ৭১টি মসজিদ, ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়, ৩টি গির্জা এবং গাজার এনডোমেন্টস ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ৫টি ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। এর বাইরে ১০৫ টি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, ১৬টি হাসপাতাল, ৩২টি স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র এবং ২৭টি অ্যাম্বুলেন্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাসপাতালের ৫০ শতাংশ এবং প্রাইমারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৬২ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। স্কুলের এক-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ৯ শতাংশে কোনো কার্যক্রম নেই। ইসরাইল যে কতটা বর্বর, তার সাক্ষী গাজা। গাজা কমিউনিটি মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত ড. আয়াদ আল সাররাজ একবার একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, মানুষ এই প্রকৃতি ও পরিবেশের সন্তান।

আপনি যদি কারো ওপর অসহায়ত্ব ও বিষাদ দিয়ে তাকে ঢেকে দেন, তাহলে সে স্বাভাবিক জীবন কী, তা বুঝতেই পারবে না। গাজাবাসীকে যেভাবে বোমা, হত্যা, রক্ত, অবমাননায় আচ্ছাদিত করে দেওয়া হয়েছে, তাতে নতুন প্রজন্মের কাছে মৃত্যুই জীবনের সহজাত প্রক্রিয়া হয়ে উঠতে পারে। ২০১৪ সালে জেরুজালেমে সরকারি রেডিওতে প্রচারিত বার ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অধ্যাপক মোরদেচাই কেদার ইসরাইলি সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য বলেছেন, অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ অনেক হয়েছে, এবার আমাদের সেনারা গাজায় ঢুকে ফিলিস্তিনি নারীদের ধর্ষণ শুরু করুক। কতটা বর্বর, কতটা পশুবত হলে এমন এমন কথা উচ্চারণ করতে পারে! এটা কী মানবতা, এ কী সভ্য জাতির মূল্যবোধ? আমরা আগামী প্রজন্মকে কি শিখাব? ওরা কি আমাদের প্রশ্ন করবে না, মানবতা, মূল্যবোধ, ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা এগুলো কি তোমরা আমাদের শিখিয়েছ? যে ফিলিস্তিনি শিশুটা মায়ের কোলে ঘুমাচ্ছে, যে শিশুরা রাস্তায় বা সৈকতে দৌড়ঝাঁপ করছে, তার সঙ্গে সন্ত্রাস, সন্ত্রাসী, রাজনীতি, সীমান্ত, দল, মূল্যবোধের সম্পর্ক কোথায়? হামাস যোদ্ধাদের নিরস্ত্র করতে গিয়ে ১২০০০ নিরীহ মানুষ হত্যা করা হলো, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, জাতিসংঘ আশ্রয়কেন্দ্র, টেলিভিশন কেন্দ্র বোমা মেরে ধ্বংস করে দেওয়া হলো, এটা কি সন্ত্রাস নয়? সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করছেন, যারা সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবী গড়বে বলে ছারখার করেছে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, মিসর, তিউনিসিয়া, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে তছনছ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের একটার পর একটা দেশ, আর পাহারা দিয়ে রাখছে মধ্যপ্রাচ্যেরই আমির-বাদশাহরা, তারা এখন কোথায়? কোথায় বাইডেন, ঋষি সুনাক, ম্যাঁখো সাহেবরা? ফিলিস্তিনি নিষ্পাপ শিশুদের আর্তচিৎকারে যখন আকাশ বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে, অবুঝ শিশুর পড়ে থাকা মৃতদেহ, যখন কাক, চিল, শকুনের আহারে পরিণত হচ্ছে, তখন কীভাবে ঘুমাচ্ছে বিশ্ব মানবতার ফেরিওয়ালা, বিশ্ব মোড়লরা? গাজায় যখন হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, ইসরাইলের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র তখন ইসরাইলকে সাহায্যের জন্য ভূমধ্যসাগরে দুটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করছে। সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। সেই দেশটি এখন চাপ প্রয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছে; যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য নয়, যুদ্ধের আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার জন্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও তার ইসরাইলি নীতির জন্য ঘরে-বাইরে সমালোচনার মুখে পড়েছেন। মার্কিন নাগরিকরা দুটি সামরিক জাহাজ আটকে দিয়েছে। মার্কিন সিনেট ১২ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার বাজেট আটকে দিয়েছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি বংশোদ্ভূতদের মধ্যে অনেক আরব আমেরিকান আছে। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাদের ৫৯ শতাংশ বাইডেনকে সমর্থন করেছিল। এই সমর্থন এখন ১৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পরাশক্তি একসময় যে বিষবৃক্ষ নামের কৃত্রিম ও বর্ণবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের নাম দিয়েছিল, সেটাই এখন বর্ধিত পরাশক্তি। ইউরোপ নেতৃত্ব দিয়েছে ইসরাইল প্রতিষ্ঠায়, সেই ইসরাইলকে লালন পালন করে আরব বিশ্বের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পরমাণু অস্ত্র, অর্থ ও সব পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে পশ্চিমাশক্তি। এখন শুধু ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়া অসম যুদ্ধ করছে না- তারা যুদ্ধ করছে তাবৎ পশ্চিমা কায়েমি স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে। তারা যুদ্ধ করছে বর্ণবাদ ও পশ্চিমা তাঁবেদার রাজা বাদশাহদের বিরুদ্ধেও। ফিলিস্তিনের গাজায় অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। হামলায় বাদ যাচ্ছে না হাসপাতালও। হামলায় গাজার সবচেয়ে বড় দুটি হাসপাতাল আল শিফা ও আল কুদস এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব চুপ করে থাকতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস গেব্রেইয়েসুস। তিনি আফসোস করে বলেছেন, হাসপাতালগুলো নিরাপদ আশ্রয়স্থল হওয়ার কথা থাকলেও এসব স্থান যখন মৃত্যু, ধ্বংস ও হতাশার দৃশ্যে রূপান্তরিত, তখন বিশ্ব চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। গত কয়েক দিন ধরে গাজার এই হাসপাতালে বিদ্যুৎ ও পানির সংকট এবং দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। এসব কারণে রোগীদের প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের কাজ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফিলিস্তিন বিশ্ব মানচিত্রে একমাত্র জনপদ, যেখানে প্রতি মিনিটে লাশের মিছিলে যোগ হয় কোনো না কোনো নিরপরাধ শিশু, অসহায় নারী কিংবা স্বাধীনতার স্বপ্নে চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ অথবা বৃদ্ধা। পৃথিবীজুড়ে শিশু অধিকার বজায় রাখার পক্ষে এত সমাবেশ, এত সহানুভূতি, এত আয়োজন, তার অংশীদার হিসেবে যেকোনো দেশ গর্বিত হতে পারে; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সত্য স্বীকার করার সততা যদি থাকে, তাহলে নির্মিম নিষ্ঠুরতার বহু চিত্রই বেরিয়ে আসবে, যা লক্ষ্য করে হৃদয়বান মানুষ হতবাক হয়ে যাবে।

পৃথিবীতে যুগে যুগে, হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতা এসেছে রক্তস্রোত ও অগ্নিদাহকে ক্ষমতার সঙ্গী করে। গাজার নির্মম ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই ইতিহাস, যারা মুখে বলে ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই।’ আর অসহায় মানুষ তাদের হাতেই মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। তাই বলতে হয়, সারা বিশ্ব কি ক্ষমা করবে এই হত্যাকারকদের, যারা মানবসভ্যতার সবচেয়ে অসহায় মানুষকে হাসতে হাসতে তুলে দেয় মৃত্যুর হাতে? কামনা করি, জেগে উঠুক বিশ্ব বিবেক, মানুষ যেন বলতে পারে, ‘আমরা চোখ মেলে আর শিশুহত্যার নারকীয়তা দেখতে চাই না। ওরা কেন ওদের অজান্তে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ভোগ করবে? শত্রুর হাতে জীবনধ্বংসী যে অভিশাপ এই নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করছে, সারা বিশ্বের শিশুদের কথা মনে রেখে কামনা করি, আর নয় হিরোশিমা, আর নয় নাগাসাকি, আর নয় হত্যার মহোৎসব। শিশুদের কথা মনে রেখে গড়ে তুলি নতুন বিশ্ব, যেখানে ওরা মানুষ হওয়ার জন্য জায়গা পাবে। জেগে উঠুক বিশ্বমানবতা। প্রতিরোধ সৃষ্টি করুক অন্যায় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে।

লেখক : প্রভাষক, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।