ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দূষণে দখলে হারিয়ে যাওয়া ঢাকার ১৫ নদী

মাহমুদ সালেহীন খান
দূষণে দখলে হারিয়ে যাওয়া ঢাকার ১৫ নদী

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর শহর হওয়ার কথা ছিল ঢাকা শহর, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা ও দূষণের শহর বলা হয় রাজধানী ঢাকাকে। ৪০০ বছরের পুরোনো এই প্রচীন শহরটি ঘিরে ছিল অসংখ্য নদী ও খাল- যা আজ বিলীনপ্রায়। ইতিহাস বলছে, ‘রামগঙ্গা’ ও ‘নারায়ণীগঙ্গা’ নামে বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী দুটি নদীর নাম উল্লেখ আছে ১৯১২ সালে প্রকাশিত যতীন্দ্রমোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে। এতে বলা হয়- ‘ঢাকা জেলার বক্ষদেশে রামগঙ্গা ও নারায়ণীগঙ্গা উপবীতবৎ (উপকণ্ঠে) শোভা পাইতেছে’। কিন্তু এর ঠিক ১০০ বছর পর নদী দুটি চিরতরেই অপরিচিত এ জনপদের মানুষের কাছে। টেমসের তীরে লন্ডন, সেইনের তীরে প্যারিস, দানিয়ুবের তীরে বুদাপেস্ট। তিন নদী এ তিন শহরকে বিশ্বে দেশগুলোকে পরিচিত করলেও রাজধানী ঢাকার চিত্র একেবারেই ভিন্ন। গবেষণা সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের পৃথক দুটি জরিপ থেকে জানা গেছে, স্বাধীনতাকালেও ঢাকা জেলায় নদীর সংখ্যা ছিল ১৫টি। এর মধ্যে আঁটি, কনাই, দোলাই, পান্ডো ও নড়াই- এ পাঁচ নদীর কোনো হদিস এখন নেই। একইসঙ্গে ঢাকাকে ঘিরে রাখা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও টঙ্গী নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ১৭টি খালও হারিয়েছে। মহানগরী এলাকায় এক সময় খাল ছিল ৭৫টি। গত কয়েক দশকে একের পর এক দখল-দূষণে নদী ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে শহর ও সুরম্য অট্টালিকা, তৈরি হয়েছে বিনোদনকেন্দ্র, মার্কেটসহ নানা স্থাপনা। অর্ধশত বছরে এসব নদী ও খালের বুকের ওপর গড়ে উঠেছে বড় বড় অট্টালিকা। একসময়ে মোগল আমলেও পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা-তুরাগ থেকে পূর্বে বালুনদীতে প্রবাহিত হতো নড়াই নদী। আজকের ধানমন্ডি লেকের পশ্চিমমুখী দুই বাহু আসলে নড়াই নদীর দুই ধারা। কোনো কোনো গ্রন্থে উল্লেখ আছে- পিলখানা হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশে যাওয়া ধারাটি ছিল পান্ডো নদী। আর এখনকার মোহাম্মদপুর হয়ে তুরাগে মেশা ধারাটি ছিল নড়াই। ঢাকায় আরেকটি নদীর নাম ছিল সোনাভান। এ নদীটি তুরাগ থেকে মিরপুর এলাকার মধ্য দিয়ে টঙ্গীর কাছে তুরাগের সঙ্গেই মিলিত হতো। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, পান্ডো নদীর অবস্থান ছিল ধানমন্ডির ঈদগাহ মসজিদ থেকে মোহাম্মদপুরের কাটাশুর পর্যন্ত। নড়াই নদীর অবস্থান ছিল বালুনদী থেকে বর্তমান কারওয়ানবাজার জামে মসজিদ পর্যন্ত। হারিয়ে যাওয়া আঁটি নদীর অবস্থান ছিল বর্তমান বছিলা ব্রিজ থেকে আঁটিবাজার পর্যন্ত। টঙ্গী নদী থেকে উত্তরা ও আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ছিল কনাই নদীর অবস্থান। আর দোলাই নদীর অবস্থান তেরমুখ থেকে পুরান ঢাকার ধোলাইখাল পর্যন্ত ছিল। নদীটি একসময় মারা গেলেও এটি ধোলাইখাল হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে কালের পরিক্রমায় দখল-দূষণে সেই ধোলাইখালও মৃতপ্রায়।

একই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া খালগুলো সংযোগ করেছিল রাজধানীর প্রধান চারটি নদীকে। সূত্রাপুর-লোহারপুল হয়ে বুড়িগঙ্গা, মোহাম্মদপুরের বছিলা হয়ে বুড়িগঙ্গা, উত্তরার আবদুল্লাহপুর ও উত্তরখান হয়ে তুরাগ, খিলক্ষেত-ডুমনি হয়ে বালু ও মানিকনগর হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিল এসব খাল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ঢাকার আশপাশে ১০টি নদী বহমান থাকলেও দখল-দূষণে তা মৃতপ্রায়। অনেক নদী শুষ্ক মৌসুমে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে দখলদাররা নদীতে মাটি ভরাট করে বানিয়েছে অট্টালিকা। কোথাও কোথাও নদীর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। এর বাইরে কল-কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, পয়োঃবর্জ্যসহ নানা কারণেই নদী দূষিত হচ্ছে। ফলে দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে নদীর গতিপথ। নদী আর খাল দখলের প্রভাব পড়েছে রাজধানীর জীবনযাত্রায়। অল্প বৃষ্টিতেই সড়কগুলো রূপ নেয় জলাশয়ের। কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা থাকছে দিনের পর দিন। ঢাকার আশপাশের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে সামান্য বন্যায়।

শুধু নদী আর খালই নয়, বিলীন হয়েছে রাজধানীতে থাকা অসংখ্য পুকুরও। গত ৯৬ বছরে পুরান ঢাকার ৯৬টি পুকুর বিলীন হয়ে গেছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। আদি ঢাকার পুকুর নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার। এতে ১৯২৪ সালের টপোগ্রাফি মানচিত্র ব্যবহার করা হয়।

ব্রিটিশ আমলে ঢাকার সীমানা ছিল অনেক ছোট। মানচিত্র অনুসারে তখন ঢাকা বলতে উত্তরে শাহবাগ, দক্ষিণে চর ইউসুফ ও চরকামরাঙ্গী, পশ্চিমে ধানমন্ডি এবং পূর্বে মতিঝিল ও ইংলিশ রোডের মধ্যবর্তী এলাকাকে বোঝানো হতো। এই ছোট এলাকার মধ্যেই ছিল ১২০টি পুকুর। সেই সংখ্যাটা এখন মাত্র চব্বিশে এসে দাঁড়িয়েছে। আদি ও নতুন ঢাকা মিলিয়ে বর্তমানে পুকুর রয়েছে মাত্র ২৪১টি। ধর্মীয় উপাসনালয়ের সঙ্গেই আছে ৪৩টি। এর বাইরে ৮৬টি বিল ও লেক রয়েছে। পুকুর, বিল ও লেক মিলিয়ে জলাশয়ের সংখ্যা ৩২৭টি জানান সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। ঢাকা ও তার আশপাশের গত ৫০ বছরে পাঁচটি নদী হারিয়ে গেছে। বেড়িবাঁধের মাধ্যমে নদীর প্রবাহ নষ্ট করেছি। এরপর আবার বেড়িবাঁধের দু’পাশেই দখল করা হয়েছে। ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর অনেক শাখা নদী ছিল, সেগুলো দখল হয়ে গেছে। আর নদী হারিয়ে যায়, তখন চেষ্টা করলেও নদীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কষ্টকর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত