পানির মধ্যেও আমাদের কেন পানির কষ্ট

প্রদীপ সাহা

প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পানি আমাদের জীবনের জন্য অপরিহার্য। পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় ৭০ ভাগজুড়েই রয়েছে পানি। কিন্তু সব পানি ব্যবহার উপযোগী নয়। পৃথিবীর মোট জলভাগের প্রায় ৯৭ দশমিক ৩ ভাগ হচ্ছে নোনাপানি, বাকি ২ দশমিক ৭ ভাগ হচ্ছে স্বাদু পানি। বিশ্বে স্বাদু পানির প্রায় ৬৯ ভাগ রয়েছে ভূগর্ভে, প্রায় ৩০ ভাগ মেরু অঞ্চলে বরফের স্তূপ হিসেবে জমা আছে এবং মাত্র ১ ভাগ আছে নদী ও অন্যান্য উৎসে। কিন্তু বিশ্বের অনেক মানুষ এখনো পর্যাপ্ত পানি পায় না। বিশেষ করে বিশ্বের অনেক দেশেই বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে। আমাদের রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির দাবি নতুন নয়। তাছাড়া ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ অথবা নোংরা পানি প্রায়ই দেখা যায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, পানি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে এমন সব সমস্যা তৈরি হচ্ছে এবং বছরের পর বছর ধরে এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। আমাদের দেশের উপকূলে পানির কোনো অভাব নেই। তারপরও সারা বছরই থাকে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। গ্রীষ্মের শুরুতে তা আরো তীব্র হয়ে ওঠে। লবণাক্ততার কারণে খুলনা অঞ্চলের অধিকাংশ নলকূপের পানি পানের অযোগ্য হয়ে পড়ে। মানুষ পানি না পেয়ে লবণপানি পান করে নানা রোগে আক্রান্ত হয়। সাধারণত উন্মুক্ত জলাধারই আমাদের খাবার পানির অন্যতম উৎস। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খুলনা জেলার বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকার পানি ও জমিতে বাড়ছে লবণাক্ততা। গ্রীষ্মের শুরুতে ওইসব এলাকায় দেখা দেয় সুপেয় বা বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ মানুষের আওতার মধ্যে পানির কোনো উৎস রয়েছে। কিন্তু এর সবটাই পানযোগ্য নয়। নিরাপদ পানি পাচ্ছে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ। তবে পানির দূষণ হিসাব করলে ৪৪ ভাগ মানুষ নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানির আওতার বাইরে আছে। বাংলাদেশে সুপেয় বা বিশুদ্ধ পানির যেসব উৎস রয়েছে সেগুলোও ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় জানা যায়, পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা ৮০ শতাংশ পানিতে ক্ষতিকর জীবাণু ই-কোলাই রয়েছে। পুকুরের পানিতেও একই মাত্রায় এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সব মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে হবে।

বিভিন্ন অঞ্চলে সুপেয় বা বিশুদ্ধ পানি সংকটের অন্যতম কারণ হলো ভূগর্ভস্থ স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। আর যে হারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষার মৌসুমে বাংলাদেশের বেশিরভাগ জায়গায় পানির ভূগর্ভস্থ স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসলেও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল এবং দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসছে না। সে কারণে এসব অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির সংকট বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় নলকূপের গভীরতা ৭০০ থেকে ১২০০ ফুটের মধ্যে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১২০০ ফুট গভীর নলকূপ থেকেও তারা পানি তুলতে পারছে না। এতে বিশুদ্ধ পানির চরম সংকটে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। খাবার পানির জন্য তাদের দূর-দূরান্তের জলাশয়ের দিকে ছুটতে হয় অথবা প্রতিদিনের পানি কিনে নিতে হয়। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এতে পানির স্তর আরো নিচে নেমে যাবে এবং উপকূলের নলকূপ দিয়ে পানি না ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হবে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো ভূউপরিভাগের পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়া। এরই মধ্যে যে কয়েকটি মিঠা পানির পুকুর রয়েছে সেগুলো হয় ভরাট হয়ে গেছে, না-হলে পানি শুকিয়ে গেছে। নদী ও খালগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় পানিপ্রবাহ কমে গেছে। সব মিলিয়ে ভূপৃষ্ঠের বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলো কমে যাচ্ছে। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খুলনার চারটি উপকূলীয় উপজেলার নলকূপ, নদী, পুকুর ও খাল-বিলে লবণাক্ততার পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। ২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক জরিপে জানা যায়, উপকূলীয় এসব উপজেলার মানুষের প্রতি লিটার খাবার পানিতে ১৫০০ থেকে ২৪০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি লিটারে ১০০০ মিলিগ্রাম। এর বেশি লবণাক্ততা থাকা মানে তা খাওয়ার অনুপযোগী। আবার চিংড়ি ঘেরে উঁচু বাঁধ না দেওয়ায় সেখানকার লবণাক্ত পানি পুকুরে ঢুকে পড়ছে এবং সেই পানি আর খাওয়ার উপযোগী থাকছে না। এমন অবস্থায় পুকুর নিয়মিত খননের পাশাপাশি লবণ-পানি শোধনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। বেড়িবাঁধ যদি ৩০-৩৫ ফুট উঁচু না হয়, তাহলে লবণ ছড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে বাঁধগুলো হয় ৫ ফুট থেকে ৭ ফুট। তাই লবণাক্ততা কোনোভাবেই আটকানো যাচ্ছে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি’ ও ‘অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি’র গবেষণায় বলা হয়েছে, মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের উপকূলের প্রায় দু’লাখ কৃষক বাস্তুচ্যুত হবেন। কারণ সেখানকার মাটিগুলো ধান চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। সূত্র মতে, ২০০৯ সালে আইলা এবং তারও আগে সিডরের তাণ্ডবের পর থেকে এসব উপকূলীয় এলাকার বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে যায়। দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে জানা যায়, ঢাকার পানির স্তর প্রতিবছর এক মিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে। অবস্থানভেদে সেটা আরো কম বা বেশি হতে পারে। বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ক্রমবর্ধমান মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। দেশের ৫৬ ভাগ মানুষ নিরাপদ পানি ব্যবহার করলেও নিম্নবিত্তদের মাত্র ৩৬ ভাগ নিরাপদ পানি পাচ্ছে। চাষাবাদের জন্য পানির অভাব দিন দিন বেড়েই চলছে। উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে লবণাক্ততা আর উত্তরের জেলাগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদের পানি সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানির অভাবে সেসব অঞ্চলে চাষাবাদের ধরনও পরিবর্তন হয়েছে। উপকূলীয় জেলাগুলোতে চাষিরা লবণ সংগ্রহ ও চিংড়ি চাষে আগ্রহী হচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যমতে, দেশের ৪১ জেলার ১৯২ উপজেলায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। রাজধানী ঢাকায় পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ২১২ ফুট নিচে চলে গেছে। যে কারণে ভবিষ্যতে এখানকার পানিতে সমুদ্রের নোনাপানি চলে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ওয়াটার এইড-এর গবেষণা মতে, দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে না। অধিকাংশ এলাকায়ই শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। কারণ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। ২০১৫ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরাম-এর গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্টে সুপেয় বা বিশুদ্ধ পানি সংকটকে বৈশ্বিক হুমকির তালিকায় স্থান দিয়েছে। কানাডার ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক গ্রাহাম কোগলি বলেন- ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে প্রায় ৬০ কোটি মানুষের বাস। তারা খুবই অনিয়ন্ত্রিত এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে মাটির নিচের পানি তুলছে।

গবেষণা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানির প্রায় অর্ধেক ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কারণ এতে লবণাক্ততা ও আর্সেনিকের মাত্রা অনেক বেশি। জলবায়ুবিষয়ক জাতিসংঘের প্যানেলের গবেষণা বলছে, প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য ২০ ভাগ সুপেয় বা বিশুদ্ধ পানি কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৪০ ভাগ এলাকায় পানি সংকট দেখা দেবে।

আমাদের দেশে পানিবাহিত রোগের প্রভাবে মৃত্যুর পরিমাণ এখনো অনেক বেশি। তাই পানির অপচয় রোধে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে এবং সুপেয় বা বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার ব্যাপারে জোরালোভাবে নিশ্চিত হতে হবে।