ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন, যেখানে পৃথিবীর অস্তিত্বের সংকট

অলোক আচার্য
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন, যেখানে পৃথিবীর অস্তিত্বের সংকট

কপ সম্মেলনে পৃথিবী এখন পর্যন্ত কতটুকু লাভবান হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তারপরও পৃথিবীকে রক্ষার আশায় বিশ্ব নেতারা একত্রিত হয়। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন। কিছু সিদ্ধান্ত হয়। জলবায়ু সম্মেলন যা কপ (কনফারেন্স অব পার্টিস) নামে পরিচিত। কপ-২৮ অনুষ্ঠিত হবে ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাইয়ে। কপ হলো বিশ্বের নেতাদের জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন। জলবায়ুতে মানুষের সৃষ্টি ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় ১৫৪টি দেশ ১৯৯২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। তারপর থেকে, জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সম্মেলন। প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আলোচনা করা হয় যে ঠিক কীভাবে এটি কমিয়ে আনার উপায় অর্জন করা উচিত এবং কী অগ্রগতি হয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করা। বাংলাদেশ ও অন্যান্য জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মিশরে অনুষ্ঠিত হওয়া ‘কপ-২৭’-এর সাফল্যগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি ‘ক্ষতি ও লোকসান’ তহবিল সৃষ্টি করা ২০১৫ সালের আগে বিভিন্ন দেশ এবং বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর গুরুত্বারোপ করলেও একত্রিতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। অবশেষে জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার লাগাম টেনে ধরতে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে বিশ্ব নেতারা একত্রিত হন। একত্রিত হলেও কার্যত খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। এর পেছনেও রয়েছে নানা কারণ। উন্নত হওয়ার দৌড়ে কেউ থামতে রাজি নয়। আর এখন জ্বালানির বড় অংশই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। স্বাভাবিকভাবে এই সম্মেলন ঘিরে পৃথিবীর প্রত্যেকেই আগ্রহ থাকে। কারণ এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জলবায়ু পরিবর্তন। এক গবেষণায় জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীতে বেড়েছে খরারপ্রবণতা। বিশেষত উত্তর গোলার্ধে এই প্রবণতা বেড়েছে ২০ গুণ। ইউরোপের তাপমাত্রা চলতি বছর তো রেকর্ড ভেঙেছে অতীতের সব ইতিহাসের। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের এই কপ-২৮ সম্মেলন সত্যিকার অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ কার্বন নিঃস্বরণ। আর কার্বন নিঃস্বরণে চীনসহ উন্নত বিশ্বের দায় সিংহভাগ। কারণ এসব দেশই তেল, গ্যাসের ব্যবহার করে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর প্রতিটি দেশই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুরাও রয়েছে ক্ষতির তালিকায়। সম্প্রতি কিডসরাইটস ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা বলছে, বিশ্বের সামনে এখন যেসব হুমকি রয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন সেগুলোর একটি।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির কারণে প্রায় ১০০ কোটি শিশু বর্তমানে অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। আর জাতিসংঘের নতুন একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে বিশ্বের দেশগুলোর সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি উষ্ণায়ন কমানোয় একেবারেই যথেষ্ট অগ্রগতি না হওয়ায় এ শতাব্দীতে তাপমাত্রা গড়ে ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার মুখোমুখি হয়েছে বিশ্ব। জানা গেছে, এবারের জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রাক-শিল্প স্তরের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামিয়ে এনে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বজায় রাখার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতিতে পৌঁছার চেষ্টা চলবে। গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনের পর থেকে বিশ্বের দেশগুলোর সরকারের কার্বন নিঃসরণ কমানোর পরিকল্পনায় দুঃখজনকভাবে অগ্রগতি হয়নি। এ পরিস্থিতিতে জরুরিভিত্তিতে সমাজে রূপান্তর ঘটানো গেলেই শুধু বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, গত জলবায়ু সম্মেলনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক নতুন করে কার্বন নিঃসরণ কমানোর যে চেষ্টা শুরু হয়েছে তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমবে ১ শতাংশেরও কম। অথচ বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে হলে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ৪৫ শতাংশ কমা দরকার।

প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে এই সম্মেলনে কতদূর অগ্রসর হতে পারবে, তা নিয়েই থাকবে প্রধান আলোচনা। প্যারিসে হওয়া জলবায়ু চুক্তি প্রথমবারের মতো বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপরীতে একত্রিত করেছে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন হওয়াই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্যারিস চুক্তিতে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম করা, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ মাত্রা কমিয়ে আনা, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সাহায্য করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করা ইস্যুগুলো। এর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য করার প্রসঙ্গও থাকবে।

বিশ্বের ১৯৬টি দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার যে সিদ্ধান্ত ছিল তা বাস্তবায়িত হলে দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নিতে পারে। কমতে পারে দেশের অভ্যন্তরে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা। কারণ উন্নত বিশ্বের অতিমাত্রায় শিল্পায়নের কারণেই বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেশি। কিন্তু ক্ষতির স্বীকার বাংলাদেশের মতো দেশগুলোই বেশি হচ্ছে। প্রকৃতিক দুর্যোগে একের পর এক বিপর্যস্ত হচ্ছে। ঋতুর বদলে যাওয়ার দৃশ্য এবং প্রকৃতির রুদ্র রূপ আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে প্রবণতা তার জন্য সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার মতো হুমকি বহন করছে।

জলবায়ু পরির্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বিশ্ব নেতাদের দায় স্বীকার করলেও সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে অনীহার কারণেই জলবায়ু সম্মেলন পৃথিবীকে সুরক্ষা দেওয়ার কাজে আসছে না। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট এখন পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এর থেকে মুক্তি পেতে কার্বন নিঃসরণ কমানো ছাড়া বিকল্প পথ নেই। ফলে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে সারাবিশ্ব একমত। বিজ্ঞানীরা টেকসই ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে আমাদের জীবনযাপনের ধরনে পরিবর্তন আনতে পরামর্শ দিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে তারা ছয়টি পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। জীবাশ্ন জ্বালানি ব্যবহারের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য কম কার্বন নিঃসরণের জ্বালানি ব্যবহার বিশেষ করে মাংসের প্রতি আসক্তি কমিয়ে উদ্ভিজ খাদ্য গ্রহণ, কার্বনমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করা। আমরা বাস্তবিক পক্ষে খুব দ্রুতগতিতে বিপদে পরতে যাচ্ছি। এর থেকে প্রতিরোধের উপায় জানা থাকলেও কাজটি একক নয় বরং সামগ্রিক। ফলে এটি দীর্ঘায়িত প্রক্রিয়া। গ্রেটা থুনব্যার্গের চাওয়া বস্তুত বিশ্বের সবারই প্রত্যাশা। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে শ্বাস-প্রশ্বাস, পানিবাহিত রোগ, মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু এবং মানসিক স্বাস্থ্যও ওপরও প্রভাব পরছে। এখন যে ডেঙ্গু রোগের ব্যাপক বিস্তার বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়া এবং অন্যান্য দেশে, তার পেছনের একটি বড় কারণ হলো এই জলবায়ু পরিবর্তন।

জলবায়ু পরিবর্তন কোনো একক ইস্যু নয় যে তা এককভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। তবে এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোই বেশি। কারণ তাদের পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করার সামর্থ্য কম। বিশ্বের যেসব দেশের কারণে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাদের সেখান থেকে বেরিয়ে টেকসই পরিবেশ গড়ায় মনোযোগী হতে হবে। শিল্পের যাতাকলে পৃথিবীর অবস্থা আজ অত্যন্ত দুর্বিষহ। শুধু উন্নয়নের দোহাই দিয়ে পৃথিবীর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় না খোঁজাটা বড় ধরনের বোকামি।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পৃথিবী প্রাণিকূলের বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পরছে। টিকে থাকা রীতিমত হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। জলবায়ু স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরিয়ে আনতে ২৮তম জলবায়ু সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে বিশ্ব নেতাদের দিকে যে তারা পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করার জন্য কি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তা দেখার জন্য। দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কপ-২৮ সম্মেলনে আমরা দেখতে চাই আগের প্রতিশ্রুতির যথাযথ বাস্তবায়ন। যদি তারা এবারও ব্যর্থতার পরিচয় দেন বা অসহযোগিতামূলক মনোভাব প্রদর্শন করেন, তাহলে পৃথিবীর অস্তিত্ব মূলত আরো বেশি সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যাবে। যেখান থেকে ফিরে আসা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। এক কথায় বলা যায়, ব্যর্থ হলে পৃথিবী নামক এই গ্রহের ধ্বংস অনিবার্য।

তখন হয়তো বিলুপ্তি খাতায় মানুষের নামও উঠে যাবে। সুতরাং ব্যর্থতা নয়, চাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত