ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মম হৃদয়ে নজরুল

মীর ইমরান আলী
মম হৃদয়ে নজরুল

কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমকালীন সমাজ আর জীবনপ্রবাহকে যেভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন, তেমন সৃষ্টিশীল উদ্যম আজও তার সাক্ষী হয়ে অনুরাগী, ভক্তদের উদ্দীপ্ত করে যাচ্ছে। তারুণ্যের উদ্দীপনা আর চেতনা ছিল এই মানবতার পূজারির সহজাত, সাবলীল, সঙ্গত কারণে নিজেকে তৈরি করেছেন বিদেশি শাসন-শোষণের অনিবার্য পরিণতিতে দীপ্ত তারুণ্যের বিপ্লবী মনস্তত্ত্ব নিয়ে। প্রথাসিদ্ধ বিরূপ প্রতিবেশকে আঘাত করাই শুধু নয়, মানুষ মানুষে ভেদাভেদ অদম্য চেতনায় নির্মূল করতে তার সৃজন নিঃশেষ সমর্থন করেছেন। নজরুল ছিলেন প্রথাসিদ্ধ সামাজিক বিরুদ্ধ বলয়ের এক অপ্রতিহত শক্তি, অপ্রতিরোধ্য সৃজন সাধক সময় আর যুগের অগ্রগণ্য নায়ক। যার শৈশব জীবনের পালাক্রমে তাকে নিজ অবস্থার প্রেক্ষিত তৈরি বাধ্য করে। নিজেকে গড়ে তুলতে যে ক্ষমতা, দক্ষতা, প্রতিজ্ঞা এবং মনন শৌর্যের অব্যাহত পর্যায়ে নিজেকে এগিয়ে নেয়া সেও এক শৈল্পসৌধের অনবদ্য জীবন গাথা।

রোমান্টি সিজমের সূত্রপাত জার্মানিতে হলেও এর বিকাশ ঘটে ইংল্যান্ডে, যদিও ইংলিশ লেখক লর্ড বায়রন, উইলিয়াম ব্লেক প্রমুখ যুগসৃষ্টিকারী রোমান্টিক কবিরা ফ্রেঞ্চ সাহিত্য ও ফ্রেঞ্চ রেভুলিউশনের দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত। ১৯৭৮ সালে কোলরিজ ওয়ার্ডসওয়ার্থের লিরিকার ব্যালর্ড প্রকাশ রোমান্টিক আন্দোলনকে দারুণভাবে নতুন গতি দান করে। প্রেমাবশ, গভীর, অনুভূতি, মিষ্টিক চেতনা, প্রকৃত, ধ্যানের রূপায়ন, অতীতমুখিতা, ক্ষুদ্রের মাঝে মহত্ত্বের প্রকাশ রোমান্টিসিজমের বৈশিষ্ট্য। যদিও নজরুলকে বাংলার বায়রন বা শেলি বলা হয়; কিন্তু কম বেশি সব রোমান্টিক কবিরাই তাকে প্রভাবিত করেন। এমনকি নজরুল রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিক ভাবনা দিয়েও প্রভাবিত আবার ফ্রেঞ্চ রেভুলিউশনের মর্মবাণী সমতা, ব্যক্তি স্বতন্ত্রবাদ ও ভ্রাতৃত্ব নজরুলকে প্রভাবিত করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। নজরুল কবিতায় যে সাম্যের কথা বলেছেন, ফ্রেঞ্চ রেভুলিউশনের মূল মন্ত্র আমরা তা পাই নজরুলের মানুষ কবিতায়। মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে মহিয়ান। নাই দেশ কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি। সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে, তিনি মানুষের জাতি। কবিতা কিংবা গান নয় সাংবাদিকতার মাধ্যমেও কাজী নজরুল ইসলাম ধারার সূচনা করেন। কাজী নজরুল সহকর্মী মুজফফর আহমদ স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন, ১৯২০ সালের ১২ জুলাই তারিখে কাজী নজরুল ইসলাম ও আমার সম্পাদনায় নবযুগ বের হলো। নিশ্চয়ই জোরালো লেখার গুণে প্রথম দিনেই কাগজ জনপ্রয়তা লাভ করে। দৈনিক কাগজের লেখার অভিজ্ঞতা আমাদের একজনেরও ছিল না। নজরুল ইসলাম কোনোদিন কোনো অফিস কাগজের অফিসেও ঢোকেনি। তবু সে বড় বড় সংবাদ পড়ে সেগুলোকে খুব সংক্ষিপ্তকারে নিজের ভাষায় লিখে ফেলতে লাগল। তা না হলে কাগজে সংবাদের স্থান হয় না। নজরুলকে বড় বড় সংবাদের সংক্ষেপণ করতে দেখে আমরা আশ্চর্য হয়ে যেতাম। ঝানু সাংবাদিকরাও এই কৌশল আয়ত্তে হিমশিম খেয়ে যান।

তারপরেও নজরুলের দেয়া হেডিংয়ের জন্য নবযুগ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিদ্রোহী কবিতা ১৯৪৭ এ ব্রিটিশ তাড়াতে যেমন অনুপ্রেরণা ছিল, তেমনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে রেখেছিল অনিমেষ অনুপ্রেরণা। রোমান্টিকদের মাঝে যেমন কল্পনার আশ্রয় আছে, বিমুগ্ধতা আছে, বাসনার পেয়ালা পূর্ণ করার বিরাট অতৃপ্তি আছে, আছে সীমার মাঝে অসীমকে খুঁজে নিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ করার প্রয়াস। রোমান্টিকরা প্রথম ধাপে নিজেকে চিনবার জানবার প্রচেষ্টায় থাকে মুগ্ধ। সক্রেটিসকে যদি আমরা আদি রোমান্টিক বলি তবে বলতে হয়, রোমান্টিক বীজ তিনি বপন করে গেছেন সবার আগে। নিজেকে জানার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে বলেছিলেন, নো দ্য শেলফ বা নিজেকে জানো।

নিজেকে জানার অর্থ হচ্ছে অন্যকে জানার প্রথম ধাপ। কবি বলেন, তার গানে অন্য ব্যঞ্জনায়, আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলো দেখতে আমি পাইনি, আমাদের হৃদয় মাঝে রয়েছে সুন্দর আর না জানা কবি আমাদের তাই দেখতে বলেন। কাজী নজরুলের বিখ্যাত উক্তি, তোমাতে রয়েছে সকল কিতাব সকল কালের জ্ঞান, সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ। প্রতিটা মানুষের মাঝে সত্য, সুন্দর, জ্ঞান, বিবেক স্ব-স্ব ভাব আছে। বিখ্যাত সাম্যবাদী কবিতার শেষে এসে নজরুল পরিষ্কার করে বলেন- মিথ্যা বলিনি ভাই, এই হৃদয় চেয়ে কোনো মন্দির-কাবা নেই।

শিক্ষার্থী

আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত