ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের দায়

শফিকুল ইসলাম খোকন
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের দায়

কেউ কেউ ভাবেন, মানুষের প্রতিষ্ঠা ও গৌরব লাভের পেছনে বংশ পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে তা সঠিক নয়। মানুষ কোন বংশে জন্মগ্রহণ করেছে তা বিবেচনা না করে জীবনে সে কী অবদান রেখে গেছে, সেটাই মানুষের মহিমাকে তুলে ধরে। সমাজের যাদের নিচু স্তরের মানুষ মনে করি, তাদের মধ্যেও জন্ম নিয়েও অনেক মানুষ কর্ম ও অবদানের মাধ্যমে বড় বলে পরিগণিত হয়েছে। মানবসমাজের ইতিহাসে এ রকম অজস্র উদাহরণ আছে। উঁচু বংশ বা নিচু বংশ বড় কথা নয়, মহৎ অবদানেই মানুষ বড় মাপের মানুষ হয়।

কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুসহ আরো অনেকে তাদের কর্মের অবদানের জন্য স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। তারা কেউ জন্মপরিচয় বা বংশগৌরবের কারণে বড় বলে পরিগণিত নন। পদ্মফুলের জন্মস্থান বড় নয়, এর সৌন্দর্য বড়। তেমনি মানুষের কর্মের সাফল্যই বড়, বংশ ও জন্মপরিচয় নয়। কর্মই জীবন। জীবনে কাজ না থাকলে জীবনই ব্যর্থ হয়। মানুষই বিভিন্ন কর্ম দ্বারা দেশ, সমাজ ও জাতির উন্নতি সাধন করে। বংশ বা জন্মপরিচয় দিয়ে দেশের উন্নতি করা যায় না। জন্ম একবার হবে, মৃত্যুও একবার নিশ্চিত হবে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন প্রত্যেকের প্রয়োজন। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন আমাদের সবার জানা দরকার এবং আইনে যাদের কর্তৃপক্ষ সাব্যস্ত করেছে, তাদেরও এ বিষয়ে জানা উচিত। আমি দেখেছি, বাংলাদেশের ইউনিয়ন পরিষদে এবং পৌরসভা অথবা সিটি করপোরেশন জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের কর্তৃপক্ষ?। কিন্তু এ সব দপ্তরে কর্মরত ব্যক্তিরাও আইনের বিষয়ে জানেন না, তারা এ ব্যাপারে উদাসিন অথচ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ এর ৮ (১) ধারায় বলা হয়েছে ‘শিশুর পিতা বা মাতা বা অভিভাবক বা নির্ধারিত ব্যক্তি উক্ত শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম সংক্রান্ত তথ্য নিবন্ধকের কাছে প্রদানের জন্য বাধ্য থাকিবেন।’ (২) মৃত ব্যক্তির পুত্র বা কন্যা বা অভিভাবক বা নির্ধারিত ব্যক্তি মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্য নিবন্ধকের কাছে প্রদানের জন্য বাধ্য থাকিবেন ২১। (১) এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধির কোনো বিধান লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।

(২) উপ-ধারা (১) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, যদি কোন ব্যক্তি জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য মিথ্যা তথ্য প্রদান করেন বা এমন কোন লিখিত বর্ণনা বা ঘোষণা প্রদান করেন, যাহা তিনি মিথ্যা বলিয়া জানেন বা বিশ্বাস করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে অথবা অনধিক ১ বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন। (৩) উপ-ধারা (১) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, যদি কোনো নিবন্ধক উপ-ধারা (২) এ উল্লিখিত মিথ্যা তথ্য, লিখিত বর্ণনা বা ঘোষণা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধন করেন, তাহা হলে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধক অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে অথবা অনধিক এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন, যদি না তিনি প্রমাণ করিতে সক্ষম হন যে ওই অপরাধ তাহার অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হইয়াছে অথবা উক্ত অপরাধ রোধ করিবার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছেন। আইনে ৯ এর (১) নিম্নবর্ণিত ব্যক্তিগণ কোনো ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য নিবন্ধকের দায়িত্বে রয়েছেন- (ক) ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং সচিব; (খ) গ্রাম পুলিশ; (গ) সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার [কাউন্সিলর]; (ঘ) ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন অথবা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মী ও পরিবার কল্যাণ কর্মী; (ঙ) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সেক্টরে নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) মাঠকর্মী; (চ) কোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক বা মাতৃসদন বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুবরণের ক্ষেত্রে উহার দায়িত্বপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার অথবা ডাক্তার বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা; (ছ) কোনো গোরস্থান বা শ্মশান ঘাটের তত্ত্বাবধায়ক; (জ) নিবন্ধক কর্তৃক নিয়োজিত অন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী; (ঝ) জেলখানায় জন্ম ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে জেল সুপার বা জেলার বা কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি; (ঞ) পরিত্যক্ত শিশু বা সাধারণ স্থানে পড়িয়া থাকা পরিচয়হীন মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা; এবং (ট) নির্ধারিত অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান।

(২) কোনো ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্য উপ-ধারা (১) এ উল্লেখিত ব্যক্তির কাছে সরবরাহ করিলে তিনি নিজে উহা নিবন্ধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন অথবা তথ্য প্রদানকারী ব্যক্তিকে নিবন্ধনের পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করিবেন; কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখছি। আমি ২০১৬ সালে সংকল্প ট্রাস্টের সহযোগিতায় নারী পক্ষের একটি প্রজেক্টে সাতটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইনে কাজ করেছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু জানতে পারলাম, ইউনিয়ন পরিষদে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন নিয়ে তেমন কোনো সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়নি, ওই সময়ে অনেক ইউনিয়ন পরিষদে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বইও ছিল না। এখন মনে হয় অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।

বাংলাদেশে ভুরিভুরি আইন রয়েছে, এটি প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদাসীন এমনকি জনগণের কল্যাণের জন্য আইন হলেও ওই আইনের বিষয়ে জনগণ কিছুই জানেন না। আইন যদি জনগণের কল্যাণের জন্যই প্রণীত হয়ে থাকে, তাহলে আমার সুপারিশ থাকবে, একটি নতুন আইন প্রণয়ন করার আগে তৃণমূলে এর উপকারিতা অপকারিতা সম্পর্কে একটি জনমত তৈরি বা সার্ভে, স্টাডি করা, একটি আইন প্রণীত হওয়ার পর গ্রামভিত্তিক, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, শহরভিত্তিক উঠান বৈঠক কর্মশালার মাধ্যমে আইনের বিষয়ে অবগত এবং সচেতনতা করা দরকার। তাহলে হবে কি ওই আইনের উপকারিতা অপকারিতা কর্মকাণ্ড, শাস্তি, দণ্ডের বিষয়ে জানতে পারবে, যার ফলে এ সব অপরাধ করা থেকে জনগণ বিরত থাকবে। আমরা দেখেছি একটি আইন প্রয়োগ হয়; কিন্তু ওই আইনের বিষয়ে জানেই না ওই ব্যক্তি অপরাধী যদি ওই ব্যক্তি যে অপরাধ করেছে, সেই অপরাধের শাস্তি বা দণ্ড যদি তিনি আগে জানতেন হয়তো ওই অপরাধ সংগঠিত হতো না। আমি বলছি না যে, সমাজ থেকে অপরাধ একেবারেই নির্মূল হবে; কিন্তু এ সব কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছুটা অপরাধ কমবে। এই আইনের বিষয়ে আমি বলতে চাই, যদি কোনো জনগণকে প্রশ্ন করা হয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন জানেন কি না, উত্তরে হয়তোবা ১০ ভাগ মানুষও জানবেন না, যদি আইন প্রয়োগকারী কর্তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় অথবা ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করা হয়, এই আইনের বিধান বলে কজনকে শাস্তি দণ্ড বা আইনের আওতায় আনা হয়েছে, উত্তরে একভাগ জবাব আসবে কি না আমার সন্দেহ রয়েছে। অথচ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য স্থানীয় সরকারের ভূমিকা সর্বোচ্চ। এর দায় থেকে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। তাহলে স্থানীয় সরকারের কাজ কি, এটি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার জন্ম মৃত্যু নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থায় থাকলেও তৃণমূলে এর কার্যকর ও ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। তাই বলতে চাই, আইন আমাদের ভুরি ভুরি রয়েছে; কিন্তু কার্যকর প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন নেই। আমরা নিজ থেকে সচেতন হই। যে আইনগুলো বিদ্যমান রয়েছে, সে আইনের মধ্যে একটা আইন পুরোপুরি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যক্তি কর্তৃক উদ্যোগ নেওয়া উচিত, একটি উদাহরণ থাকা উচিত; যেহেতু জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন আমাদের প্রতিটি নাগরিকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সব ক্ষেত্রে সব কাজে এই নিবন্ধন জরুরি। এ নিবন্ধন ছাড়া কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন তাদের উদ্যোগ নেওয়া উচিত, যে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইনের বিষয়ে জনগণকে সচেতনতা ব্যক্তির জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক উঠান বৈঠক করা।

‘নির্ভুল জন্মণ্ডমৃত্যু নিবন্ধন করব, শুদ্ধ তথ্যভান্ডার গরব’ এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল। সম্মিলিত এবং আন্তরিকতা না থাকলে কখনই শুদ্ধ তথ্যভান্ডার গড়ার সুযোগ নেই। তাই এখন সময়ের দাবি মাত্র। কথায় বলে জন্ম যদি সঠিকভাবে না হয়, সে জন্ম আসলে জন্ম বলা যায় না। আবার এও বলা হয়ে থাকে ‘জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো’ মানুষ পৃথিবীতে স্মরণীয় ও বরণীয় হয় তার কর্মগুণে। সেই সঙ্গে জীবনে গৌরব ও মর্যাদার আসন লাভের পেছনেও থাকে কর্মের ভূমিকা।

কর্মের দ্বারা মানুষ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জন্মের বা বংশের তথ্য সেখানে গৌণ। তাই একটি শিশু জন্মগ্রহণ করলে সে থাকে নিষ্পাপ; আমাদের কর্মের জন্য অনাগত শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার আমাদের নেই। ডিজিটালের পর স্মার্ট বাংলাদেশে আসলেও এখনো জন্ম নিবন্ধন পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক হয়রানি হতে হচ্ছে নাগরিকদের। মাঠ পর্যায় এবং পারিবারিক পর্যায় অধিকাংশ মানুষই জানেন না, শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদে নিবন্ধন করতে হয়। কিন্তু এ নিয়ে পরিবার, অভিভাবক ও কর্তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। পরিশেষে বলতে চাই, অনাগত শিশুর ভবিষ্যৎ আমরা সুন্দর করে গড়ে তোলার সহযোগিতা করি, একটি নির্ভুল জন্মণ্ডমৃত্যু নিবন্ধন তথ্যভান্ডার গড়ে তুলি, তাহলে অনাগত শিশুর ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে, টেকসই উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজাতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতায়ন করতে হবে। নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : শফিকুল ইসলাম খোকন, সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক

[email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত