জাতীয় জীবনের অগ্রগতির মূলমন্ত্র শিক্ষা

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সভ্যতার প্রধান উপাদান হলো শিক্ষা। যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। কোনো জাতি ও সভ্যতার উত্থান-পতনের সঙ্গে শিক্ষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিক্ষার আলোয় মানুষ অন্ধকারকে জয় করে। অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ পায়। মুক্তির পথের দিশা খুঁজে পায়। আলো-আঁধার, ভালো-মন্দ, নীতিনৈতিকতা ও ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পরখ করার অন্যতম মাধ্যম হলো শিক্ষা। শিক্ষা মানবপ্রাণের লুক্কায়িত পশুত্বকে অবদমিত করে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। মানুষকে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অধিকারী করে তোলে। তাই শিক্ষাকে মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাই জাতীয় জীবনের অগ্রগতির মূলমন্ত্র হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। এ কারণেই শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। শিক্ষা যে, শুধুমাত্র একটি জাতির মেরুদণ্ড তা নয় বরং শিক্ষা মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। সুনির্দিষ্ট দর্শনভিত্তিক শিক্ষা মানুষকে সব ধরনের কুপ্রবৃত্তি কুসংস্কার অসদাচরণ হতে রক্ষা করে আলোকিত মানুষ, সমাজ ও একই সঙ্গে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলে। আমাদের সংবিধানে উল্লেখ আছে, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। একই সঙ্গে জন্মগত অধিকার। শিক্ষা শুধু অধিকারই নয়, জাতি গঠনের মূল স্তম্ভও বটে। এই শিক্ষা লাভে কেউ কাউকে বাধা প্রদান করতে পারে না, তেমনি শিক্ষা কেউ কেড়ে নিতেও পারে না। পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া একমাত্র বিবেচনার বিষয় হতে পারে না। আমি ভালো মানুষ হলাম কি না, আমার মধ্যে মানবিকতাবোধ, নৈতিকতাবোধ আছে কি না, আমি একজন সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠলাম কি না, আমি সুস্থ, সুন্দর মন নিয়ে বড় হচ্ছি কি না, সেটা সবার আগে বিবেচনার বিষয়। মানবিক মূল্যবোধ, নীতি আদর্শ, সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা ও নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষই প্রকৃত মানুষ। কিন্তু এদিক বিবেচনায় না নিয়ে শুধু আমাদের সন্তানদের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সরকারি বেসরকারি চাকরিজীবী বানাতে চাই। পাশাপাশি মানুষ হওয়ার যে তাগিদ তা অনুভব করি না। আজকাল সার্টিফিকেট অর্জনই প্রায় সবার লক্ষ্য। আমার সন্তান কতটা মানবিক জ্ঞান সম্পন্ন হলো, কতটা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হলো কিনা, সেদিকে কারো খেয়াল নেই। বিদ্যা যেখানে অর্থের বিনিময়ে বেচাকেনা হয়, সেখানে সুশিক্ষা মেধার বিকাশ বা শিক্ষার মান বড় কথা নয়, সার্টিফিকেট অর্জনই মুখ্য। প্রতি বছর যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করে এবং তাদের মধ্যে অনেকে ভালো ফল অর্জন করে।

কিন্তু কতজন শিক্ষার্থী প্রকৃত মেধার বিকাশ ঘটেছে এ প্রশ্ন অস্বাভাবিক, অপ্রাসঙ্গিক বা অবাস্তব নয়। পাস করা ও শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয়, এটা আমাদের মেনে নিতেই হবে। প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে মন মস্তিষ্ক ও অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটানো। সার্টিফিকেটের সঙ্গে শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা সুশিক্ষা ও শিক্ষার হারকে এক করে ফেলি যা মোটেই ঠিক নয়। একটি দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে যদি প্রকৃতপক্ষে গড়ে তোলা যায়, তাহলে দেশের জন্য সবার জন্য মঙ্গল। আর মানসম্মত, শিক্ষাই পারে দেশকে সার্বিক দিক থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এ কারণে প্রতিটি দেশ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করে থাকে। সমাজ ও যুগের চাহিদা এবং সমকালীন জ্ঞানের যে বিস্তার ঘটেছে, তার দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের দেশেও একটি শিক্ষা নীতি চালু হয়েছে। এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে যেন সর্বোত্তম ফল লাভ করা যায়। সে জন্য শিক্ষা নিয়ে গবেষণা বা ভাবনার শেষ নেই। যুগে যুগে প্রতিটি দেশে জ্ঞানী-গুণী মনীষীদের ভাবনায় শিক্ষাই প্রাধান্য পেয়েছে।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, যুগের চাহিদা অনুযায়ী বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষায় গড়ে তুলতে হবে যাতে করে তারা দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত হয়। একটি জাতিকে কীভাবে সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত করা যায়, কীভাবে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা যায়, একটি দক্ষ ও মেধাভিত্তিক সমাজ গঠন করা যায়, এ নিয়ে শিক্ষাবিদদের ভাবনার শেষ নেই। আমরা সবাই জানি যে, একটি জাতির সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা শুধু যে মানবজাতির পরিবর্তন ঘটায় তা নয়, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ন্যায়বিচার-সুশাসন প্রতিষ্ঠা আম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে, আত্মদর্শন ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণে ব্রতি হওয়া। তাহলেই সেই শিক্ষার দ্বারা সমাজ-সভ্যতা, দেশ-মানবসেবা, মানবতাবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ একটি জাতি গঠনে সক্ষম হবে। এর ব্যত্যয় হলে শিক্ষা হবে ব্যক্তি কেন্দ্রিক, সমষ্টিগতভাবে সে শিক্ষা মানবজাতির কল্যাণে তেমন কোনো অবদান রাখতে পারে না। নতুন শিক্ষাক্রম একজন শিক্ষার্থীকে সজ্জন সম্মানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে পারবে। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার দৃঢ় মানসিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ, মনুষ্যত্বের অধিকারি হবে। পাসের হারের দিক থেকে দেশ এগিয়ে গেলেও শিক্ষার মান বাড়ছে কি না- এ নিয়ে শিক্ষাবিদ সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিশিষ্টজনদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এখন শিক্ষার মান বাড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু যে যা-ই বলুন না কেন, আমাদের শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মানসিকতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিকাশ লাভ করে তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। এটা শুধু প্রাথমিক পর্যায়েই নয়, শিক্ষার সব স্তরে হওয়া উচিত। জ্ঞান, মেধা-মনন শক্তির উপযোগী এবং এ বিষয়ে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাহলে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আমরা পিছিয়ে পড়ব।

বর্তমান ও অনাগত শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের সামনে সোনালি দিন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাদের ভবিষ্যৎকে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই রাষ্ট্রকেই শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কেন না, আজকের শিশুরা নানা দিক থেকে লাঞ্ছিত, নিগৃহিত, অপমানিত হচ্ছে। সর্বত্র জ্ঞানের বিস্তরণ ঘটাতে হবে। আমাদের লাখো শিক্ষার্থীদের এগিয়ে যেতে হবে জ্ঞান, মেধা অর্জনে সামনের দিকে। আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে; কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান সে অনুযায়ী বাড়েনি। পাস করলে সার্টিফিকেট পাওয়া যতটা সহজ শিক্ষিত হওয়া ততটা সহজ নয়। আর শিক্ষা হচ্ছে অর্জনের বিষয় এটা অর্জন করতে হয় নিজস্ব মেধা, স্বকীয়তা দিয়ে। প্রকৃত মানুষ হতে আমাদের ভাষা শিক্ষা সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে হবে এবং নিজকে বিকশিত প্রতিষ্ঠিত করতে হবে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে। এটাও বিবেচনায় নেওয়া দরকার যে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সার্টিফিকেট লাভ বা চাকরি পাওয়া নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টায় শিক্ষা। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য নৈতিকতা অর্জন। সব প্রকার কুদৃষ্টি, কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত হয়ে সর্বক্ষেত্রে সততা, মূল্যবোধ অর্জনের মাধ্যমে মানুষ হওয়া। কর্মজীবনে যে পেশায় প্রবেশ করো না কেন, সততা, নৈতিকতা, শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটাতে হবে। যা করা উচিত, যা করা উচিত নয় এ মানবিক মূল্যবোধের, মনূষ্যত্বের অধিকারী হও, এটাই প্রত্যাশা করি। শিক্ষার মূল লক্ষ্য মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান। সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে প্রতিটি শিক্ষাস্তরে যেন মানবিক ও নৈতিকতানির্ভরতাকে পাশ কাটানোর কোনো সুযোগ না থাকে, সেদিকে আরো মনোযোগ দিতে হবে।

যে শিক্ষায় মানবিকতা কিংবা নৈতিকতা না থাকে, তবে সে শিক্ষা থেকে হয়তো সমাজ রাষ্ট্র খুব বেশি উপকৃত হতে পারে না। একই সঙ্গে একজন শিশুর প্রথম শিক্ষালয় যেহেতু তার পরিবার এবং প্রথম শিক্ষক তার পিতামাতা সেক্ষেত্রে পরিবারকেও একজন শিক্ষার্থীর মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে। প্রতিটি শিক্ষালয় শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তি ও শিক্ষকবৃন্দকে এ ব্যাপারে কাযর্কর ভূমিকা নিতে হবে। এতে সমাজ ও দেশ হবে সমৃদ্ধশালী। আরো উজ্জীবিত হবে স্বজাতির সভ্যতা। সব সমাজেই একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া হচ্ছে পরীক্ষা। আকাশছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে যারা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে, তাদের মধ্যে অনেকেরই স্বপ্নপূরণ হয়েছে। যাদের হয়নি, তাদের হতাশ হওয়ার কিছুই নেই। আজ হয়তো হয়নি, কাল হবে- এই আত্মশক্তি ও বিশ্বাস যাদের রয়েছে, তাদের স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই। মানুষ শুধু বুদ্ধিমান প্রাণীই নয়, তার একটি নৈতিক ও সামাজিক সত্তাও রয়েছে। সে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে ভালোবাসে এবং সমাজ ও মানুষের প্রতি একটি দায়বদ্ধতাও সে অনুভব করে। এ কারণে মানব সন্তানকে তার নিজস্ব সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কেও জানতে হয় এবং নিজ সমাজ ও রাষ্ট্রের একজন আদর্শ, সৎ ও যোগ্য সদস্য ও নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার একটি তাড়নাও সে অনুভব করে। এভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, মানব শিশুকে যথার্থ মানুষ হয়ে উঠতে হলে তাকে অনেক কিছু জানতে ও বুঝতে হয় এবং নিজের ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দর করার লক্ষ্যে জীবনের একটি বিরাট সময় পর্যন্ত তাকে জ্ঞান অর্জন ও আত্মগঠনের কঠোর সাধনা ও অধ্যবসায়ে নিয়োজিত থাকতে হয়। বলা বাহুল্য, এই কঠোর অধ্যবসায় ও সাধনার মাধ্যমে সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠার মধ্যেই মানব সত্তার শ্রেষ্ঠত্ব এবং তার বিশেষত্ব ও সার্থকতা নিহিত।