এইচএসসিতে ফল বিপর্যয়

হরতাল-অবরোধেও বিপন্ন হতে পারে শিক্ষাজীবন

প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমেছে। গত বছরের চেয়ে পাসের হার কমেছে ৭.৩১ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ কমেছে ৮৩ হাজার ৯১৭টি। অন্যান্য কিছু সূচকেও নেতিবাচক ফল হয়েছে এবার। ফলাফলের এ অবনমনের কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে চারটি কারণ চিহ্নিত করেছে শিক্ষাবোর্ডগুলো। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার প্রভাব থাকার পরও এইচএসসিতে সবগুলো বিষয়ে পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা, ইংরেজিতে ব্যাপক দুর্বলতা, যশোর শিক্ষাবোর্ড বিশেষভাবে খারাপ করা এবং করোনার সময়ের স্টাডি গ্যাপ এবার ফলাফলে ফেলেছে। এছাড়া, এ ব্যাচটি প্রায় ১ বছর ঘরে বসে অনলাইনে ক্লাস করেছে। এর প্রভাবও পড়তে পারে ফলাফলে। অবশ্য শিক্ষামন্ত্রীর দাবি, এই ফলাফল স্বাভাবিকই আছে, খারাপ নয়। করোনার আগের বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, পাসের হার সাধারণত ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের ঘরেই ছিল। মাঝে ২০২১ ও ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাসের হার বেড়ে ৯০ শতাংশের বেশি হয়েছিল। এর কারণ ছিল সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কম বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া। এ বছর আগের মতো স্বাভাবিক নিয়মে পরীক্ষায় ফেরায় ফলাফল ৮০ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে। শিক্ষাবোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার যারা এইচএসসি পরীক্ষায় বসেছিল, তারা ২০২১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছিল। করোনার সময় এই ব্যাচটির সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হওয়ায় ওই বছর পাসের হার ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। একাদশ শ্রেণির শুরুতে ২০২১ সালে তারা স্বাভাবিক ক্লাস করতে পারেনি, অনলাইনে ক্লাস হয়েছে। যদিও ২০২২ সালে পুরো ১ বছর তারা ক্লাস করেছে। তারপরও ১ বছর করোনার কারণে যে সমস্যা হয়েছিল, তার প্রভাব পড়েছে ফলাফলে। এ বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার জানিয়েছেন- বলেছেন, গত দুই শিক্ষাবর্ষে বিশেষ ব্যবস্থায় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। তবে এবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ও পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা হওয়ায় স্বাভাবিক ফলাফল হয়েছে। গত ২ বছরের ফলাফলের চিত্র মূলত সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের। এছাড়া, সাধারণ ৯টি শিক্ষাবোর্ডে ইংরেজি পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছে। কারোনা মহামারির আগের ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালে গড় পাসের হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে ওই বছর কোনো পরীক্ষা হয়নি। সেবার অটোপাস দেওয়ায় শতভাগ পাস ছিল। ২০২১ সালে পাসের হার ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০২২ সালে পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫ ভাগ। এবার পাসের হার ৮০ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

এবারের এইচএসসিতে পাসের হার ও জিপিএ-৫-এর এ চিত্র বলছে, করোনার আগে আর পরের বছরগুলোর ফলাফলের চিত্র কাছাকাছি। পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমার ব্যাখ্যায় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, করোনার আগের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখবেন পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটি এমনই ছিল। করোনা মহামারির কারণে ২০২১ ও ২০২২ সালের পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হয়েছিল, তাই শিক্ষার্থীরা এক ধরনের সুবিধা পেয়েছিল। যেটা এবার ছিল না। করোনা মহামারির কারণে ২০২১ এবং ২০২২ সালে পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা হয়নি। ওই ২ বছর ৫০ শতাংশ এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে ৭৫ শতাংশ সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছে। সে কারণে ওই ২ বছর ফলাফল ছিল যথাক্রমে ৯৫ দশমিক ২৬ ও ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এবারে সব বিষয়ে এবং পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা হয়েছে। এ জন্য গতবারের চেয়ে এবার পাসের ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, যখন বিষয় কম, কম সময়ে পরীক্ষা হয়েছে, তখন সবার প্রস্তুতি অনেক ভালো। আর এবার সব বিষয়ে হয়েছে, পূর্ণ সময়ে হয়েছে। জিপিএ-৫ এর ক্ষেত্রে একটা ফারাক হতেই পারে। এটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। তিনি বলেন, আসলে এবারের সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করতে হবে করোনা পূর্ববর্তী সময়ের সঙ্গে। সেই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে আগের চেয়ে ফলাফল আসলে একটু ভালো হয়েছে। ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার যশোর শিক্ষাবোর্ডের ফল অস্বাভাবিক খারাপ হয়েছে। এই শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার ৬৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এই শিক্ষাবোর্ডে খারাপ ফলের কারণে সার্বিক ফলাফল নেতিবাচক দেখাচ্ছে। তবে আন্তঃশিক্ষাবোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার বলেন, যশোর শিক্ষাবোর্ডের খারাপ ফল হওয়ার কারণে সব বিভাগের ফলাফলে প্রভাব পড়েছে এবং গড় পাসের হার কমেছে।

বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব বিভাগের কমন আটটি বিষয়- বাংলা, ইংরেজি, পদার্থ, রসায়ন, তথ্য ও প্রযুক্তি, পৌরনীতি এবং হিসাব বিজ্ঞানে গড় পাসের হার ৯০ শতাংশের বেশি। বিপরীতে সাধারণ ৯টি শিক্ষাবোর্ডে ইংরেজিতে গড় পাস করেছে মাত্র ৮২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এটাও সার্বিক ফলাফল খারাপের একটি কারণ। এছাড়া, দিনাজপুর বোর্ডে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে খারাপ ফল হয়েছে। এই বোর্ডে হিসাব বিজ্ঞানে পাস করেছে ৬৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। জানতে চাইলে যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. আহসান হাবীব জানান, এ বোর্ডে ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীরা অস্বাভাবিক খারাপ ফল করার কারণে বোর্ডে গড় পাসের হার কমেছে। এছাড়া, মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরাও বেশি ফেল করেছে। যার প্রভাব সার্বিক ফলাফলে পড়েছে। পরীক্ষার ফলে করোনা হোক কিংবা শিক্ষা ব্যবস্থার পদ্ধতিগত যে কোনো কারণেই হোক ফলাফল যে বিপর্যয় ঘটেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। করোনার মতো বৈশ্বিক সংকট সমাধান করা সম্ভব হলেও বিএনপির নেতৃত্বে বিদ্যমান হরতাল-অবরোধ করোনার চেয়ে কম ধ্বংসাত্মক নয়। করেনাকালীন সময়ের মতো হরতাল- অবরোধে শিক্ষার্থীরা ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। তারা স্বস্তির সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কোচিং কিংবা টিউটরের কাছে যেতে পারছে না। অভিভাবকদেরও ঘুম হারাম হয়ে গেছে। আগামীতেও পাবলিক পরীক্ষায় যদি এমন ফলাফল আসে, সে জন্য কে কাকে দায়ী করবে। হরতাল-অবরোধের বিকল্প কোনো কর্মসূচি রাজনীতিবিদদের বের করতে হবে। কেন না, আমাদের দেশে যারা বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের সন্তানরাও তো লেখাপড়া করে। তাদেরও তো পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। রাজনীতিবিদদের কারণে আমাদের সন্তানদের জীবন বিপন্ন হবে- এটা মোটেও কাম্য নয়। সে কারণে আগামী দিনে কান্ডারি দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে তারা কোনো প্রকার বাধা-বিপত্তি ছাড়াই তাদের শিক্ষা জীবন শেষ করতে পারে।