অপরিকল্পিত আবাসনে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে

আরিফ আনজুম

প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের বাংলাদেশ মূলত একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এ তিন-চতুর্থাংশে মানুষের জীবনজীবিকা চলে কৃষি উৎপাদন ও কৃষিবিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আবসনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও জমির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে কৃষি জমির ওপর চাপ ক্রমবর্ধমান। আমাদের অভিনব পরিকল্পিত অর্থনীতি ব্যতীত এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনা সম্ভব নয়। সীমিত আয়তনের এই দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে অন্যান্য বিষয়াদির খাতেও প্রসারে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। নতুবা এক দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হবে আমাদের জনজীবনের। কারণ, আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ দিন দিন তীব্রভাবে হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামীর জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বলা চলে।

এক জরিপে দেখা গেছে, আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার বিঘা বা ৬৯২ একর কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক বিবেচনায় কৃষি জমির মাত্রারিক্ত ব্যবহারের কারণে। এসব জমির বেশির ভাগই অকৃষি খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে।

পাশাপাশি জলাশয় ভরাটের মাধ্যমে প্রতিদিন কৃষি জমি কমছে ৯৬ বিঘা। পরিস্যংখান থেকে আরো জানা যায়, গত ২০০৩ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত মোট ২৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩১ একর কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। এই হিসেবে বছরে এ রূপান্তরের পরিমাণ ৭ লাখ ৩০ হাজার ৩২৬ বিঘা জমি। প্রতিদিন কমছে, ২ হাজার বিঘা কৃষিজমি।

এছাড়া আমাদের ভূমি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘এ্যাসেনসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মোট ভূমির পরিমাণ প্রায় ১৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন হেক্টর। এর মধ্যে প্রায় ১৩ দশমিক ৩ শতাংশজুড়ে রয়েছে বনভূমি।

২০ দশমিক ১ শতাংশের স্থায়ী জলাধরা, ঘরবাড়ি, শিল্প-কারখানা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি। অবশিষ্ট ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ জমি কৃষি কাজের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশে কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৭৬ লাখ ৮৪০টি। তাদের প্রায় ৬০ ভাগই প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক। কৃষি জমি অকৃষিতে রূপান্তরিত হওয়ায় এ প্রান্তিক কৃষকদের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে, যা আগামীতে আরো বেশি ভয়াবহের দিকে পতিত হচ্ছে আমাদের কৃষি কাজের জন্য।

আমরা যেহেতু কৃষি প্রধান দেশের নাগরিক, সেহেতু আমাদের কৃষি নিয়ে এবং কৃষি জমি নিয়ে বিস্তর ভাবতে হবে।

তাছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে কৃষি জমি রক্ষা করাটা অতীব জরুরি। পরিসংখ্যান থেকে আরো জানা যায়, বছরে ২৫ লাখ মানুষ বাড়ছে। এই বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা ও আবাসনের বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশে ভূমি ব্যবহারের জন্য নীতিমালা তৈরি করাটা এখন খুব জরুরি একটি সমপযোগী পন্থা প্রয়োগ করা উচিত।

যার অভাবে দেশে ভূমি ব্যবহারের সমন্বিত পরিকল্পনা নেই। তাই রাষ্ট্র জমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারছে না বা ব্যর্থ হচ্ছে। এজন্য দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। যে হারে কৃষি জমি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, তার মধ্য দিয়ে জাতি চরম সংকটের দিকে এগিয়ে চলছে। ভবিষ্যতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা। তাই আর বসে থাকার সময় নেই। এখন যুগোপযোগী পন্থা অবলম্বন করাটা খুব জরুরি।

আগামীর বাংলাদেশকে শান্তির ও সুরক্ষিত রাখার জন্য দেশের সব রকমের জমি ব্যবহার এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা বা নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। দেশে রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ বিভিন্ন রকম স্থাপনা অনেকটা অপরিকল্পিতভাবেই করা হচ্ছে। এর ফলে প্রচুর পরিমাণ জমি নষ্ট হচ্ছে। গ্রামীণ কৃষি জমি রক্ষায় বিচ্ছিন্নভাবে বাড়ি নির্মাণ না করে গ্রামগুলোকে ছোট ছোট শহরে পরিণত করার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে, যাতে করে আমাদের আবাদি কৃষি জমির পরিমাণ কিছুটা হলেও রক্ষা হবে। জনবসতি হবে আরো সুনিবিড় ও সুরক্ষিত।

বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয়ের যে তথ্য রয়েছে তাতে দেশে জনসংখ্যার বিষয়টি মাথায় রেখে কৃষি জমি রক্ষার পরিকল্পনা মাফিক জনবসতির জন্য আবাসন প্রকল্প নির্মাণ নীতিমালা ও বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরি।

দেশের প্রায় ৮০ লাখ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ হেক্টর জমি বাড়ি-ঘর ইত্যাদির জন্য হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা বহাল থাকলে ২০৫০ সালে দেশে জনসংখ্যা হবে ২৩ কোটি। তখন কৃষি জমি গাণিতিক হারে হ্রাস পাবে। সুদূরপ্রসারি দৃষ্টিতে কল্পনা করলে অনুধাবন করা যাবে, তখন সমগ্র দেশই শুধু ঘর বাড়িতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। কৃষির জন্য কোনো জমিই অবশিষ্ট থাকবে না। প্রসঙ্গত এবং বহুল ভাবনার একটাই প্রশ্ন তা হচ্ছে, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাবার উৎপাদিত হবে কোথায় এবং কীভাবে?

বহুল আলোচিত বর্তমানের চলমান কার্যক্রম জরুরিভাবে বন্ধ করে কৃষি জমি রক্ষায় জাতীয়ভাবে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে এ বিষয়ে সচেতনতা লক্ষণীয়।

চার থেকে পাঁচ তলা ভবন নির্মাণের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আবাসন সমস্যা মিটানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। যদি চার থেকে পাঁচতলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে তা হবে বড় ভুল। যারা সরকারকে এ পরামর্শ প্রদান করছেন, তারা সঠিক কাজটি করছেন না বলে মনে করি। কেন না, অল্প কয়েক বছর পরই ওইসব ভবন ভেঙে ফেলে ১৫ থেকে ২০ তলা বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে। অগত্যা যদি বর্তমানে অর্থ সংকটের কারণে চার থেকে পাঁচ তলা করতে হয়, সেক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২০ তলা বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশন রাখা উচিত হবে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক এবং কৃষিসহ সব দিকটাই উন্নতির শিখরে যেতে সক্ষম হবে। এছাড়া কৃষি জমির পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ থেকে রক্ষা পাবে।

প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক

আমতলী মডেল উচ্চ বিদ্যালয়

শিবগঞ্জ, বগুড়া।